Categories


শনি-রবি

সরমা যা বলেন সেটা ভুল নয়। চুলের ওপরে না হয় কলপ মাখানাে যায়, কিন্তু হাড়ের ভেতরে কলপ লাগাবে কেমন করে? চুলে কলপ দেওয়ার অভ্যেসটা এতদিনে ছাড়িয়েছেন বড়বৌদি। কিন্তু চুলগুলাে এখনও ধপধপে শাদা হলাে না। তারও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন সরমা। বলেছেন, “এখন কিছুদিন মেহেন্দী লাগাও ছােঠাকুরপাে। তােমাদের গাইয়ে-বাজিয়েদের মধ্যে তাে মেহেন্দীর বেশ চল রয়েছে। পরে ঠিক হয়ে যাবে।”


পাড়ি

‘ছ’ বছরের মেয়ে, রাত জাগবে কী? ওর তােমার মতন তাে কিছুই পারার কথা নয়, শমী। তবু তাে মিতুল প্রচুর কিছু পারে। সকালে উঠে নিজে নিজেই মুখটুক ধুয়ে স্কুলের পােশাক পরে তৈরি হয়ে নেয়। সেটা কম কথা? এবার দেখাে, মিতুলই তােমাকে বেড-টী করে দেবে।


উড়াল

আমার সামনে সেই মেয়ে। যাকে ক’দিন ধরেই লক্ষ্য করছি। ও-ও কি। সেটা খেয়াল করেছে? ঘন চন্দনবাটার মতাে রং। এক-পিঠ কালাে চুল। পুয়ের্তোরিকান? মেক্সিকান? নাকি ক্রেওল? অ্যাকসেন্ট থেকে বােঝা গেল না। কি জানি কালাে মেয়েও হতে পারে। অনেক কৃষ্ণাঙ্গদের গায়ের রং বেশি কালাে হয় না। নাঃ, কৃষ্ণাঙ্গ নয়। হতে পারে না। ওই নাক, ওতে অন্য ইতিহাসের চিহ্ন। হয়তাে ইহুদী হতে পারে। টানা সােজা, লম্বা, কালাে চুল কোমর পর্যন্ত। চওড়া কালাে চামড়ার ওপরে রুপােলি স্টীলের বােতাম লাগানাে বেল্ট-টা পর্যন্ত একটা ভারী সিল্কের পর্দার মতাে ঝুলছে। হিস্পানিক মেয়েই হবে। ইংরেজি উচ্চারণ যদিও খুব স্পষ্ট, হিস্পানিক অ্যাকসেন্ট নেই।


ধূসর বিষাদ

বাতিকে ধরেছে। নতুন কেন বলব, আগেও ছিল। তবে এতটা ছিল না। ভাস্বতী আবার একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল—সন্দেহবাতিক রে । সারাক্ষণ নােংরা নােংরা সন্দেহ মাথায় ঘুরছে। তুমি ওই ছেলেটার সঙ্গে কথা বলাে কেন ! ওর দিকে তাকিয়ে হাসলে কেন! অফিস থেকে ফিরতে এত রাত হল কেন! রাহুলকে তাে তােরা দেখেছিস, বুবলুর জন্মদিনে এসেছিল, খুব ক্যারিকেচার করছিল...তনুশ্রীর ভাই...আমার থেকে ছেলেটা কত ছােট, আমার ভায়ের মত...তাকে নিয়ে পর্যন্ত কী ভাষায় যে কথা বলে তুই কল্পনাও করতে পারবি না দাদা।


তিস্তা যাবেই

আজ রাত দশটায় মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছিল পরাগ। গত দেড় ঘণ্টা ভীষণ অসহায়ভাবে কেটেছে তার। এখন সে হাওড়া স্টেশনে। মেন লাইনের শেষ লােকালে বসে আছে। যাত্রীদের বদান্যতায় সিট পেয়েছে জানলার পাশে। ক্রমে ফিরে পাচ্ছে সেই বিশ্বাস। লাস্ট ট্রেনে ফিরলে বােঝা যায় এখনও বেশ কিছু হৃদয়বান মানুষ আছে। পৃথিবীতে। ট্রেনে উঠেই উল্টোদিকের দরজায় চলে গিয়েছিল পরাগ। আশঙ্কা ছিলই, কিছুক্ষণের মধ্যেই পেট আঁচিয়ে উঠে এল যাবতীয় মদ ও খাবার। ঘণ্টাখানেক আগে তিস্তার জামাইবাবু পার্ক স্ট্রিটের রেস্টোরেন্টে বসিয়ে খাইয়েছিল ওই সব।


গল্প সমগ্র-২য়

যার নাম সুখেন্দু, সে তখনও চা-এর গ্লাস হাতে নিয়ে বসে থাকে। মুখখানা শুকননা । কপালে অল্প ঘামে ধুলাে মেশানাে। অনেক দূর থেকে গাড়ি চালিয়ে এসেছে, গাড়িটা রাস্তার ওপাশে, কালাে রঙের মােটর, খানিকটা গাছের ছায়ায়, খানিকটা রােদুর লেগে আয়না হয়ে আছে। চা-এর গ্লাস ধরা সেই যার নাম সুখেন্দু, সে বললো, আমার বড় খিদে পেয়েছে, আমি আর ড্রাইভ করতে পারবাে না—এখনাে দু ঘন্টা।


তনু অতনু সংবাদ

ডুডুয়া একটি নদীর নাম। পাহাড়ি ঝরনাগুলাে মিলে মিশে সমতলে পৌঁছে নদীর চেহারা নেয়, এ নদীও নিয়েছিল। নিয়ে মাইল তিরিশেক গিয়ে সব জল ঢেলেছে জলঢাকার পেটে। অতএব নদীর দৈর্ঘ্য বেশি নয়। তবে এর জল শীত গ্রীষ্মে কমে গেলেও একেবারে শুকোয় না। তখন বেশ শান্ত বালিকার মতাে তিরতিরিয়ে বয়ে যায়। ওইটুকু যাওয়ার পথে তাকে একবারই মাথার ওপর সেতুকে মেনে নিতে হয়েছে।


অনুপ্রবেশ

লুইস ব্রাউনের পিতামহ কাজ করতেন অসমের চা বাগানে। পিতামহকে সে দেখেনি। তার জন্মের আগেই তিনি মারা যান। পিতামহী স্থায়ীভাবে কখনােই অসমে থাকেননি। লন্ডনের বাড়িতেই থাকতেন। জীবনে দু’বার তিনি স্বামীর কাছে। এসেছিলেন বেড়াতে। বেশিদিন থাকতে পারেন নি। স্বামীর প্রতি ভালােবাসা যে তাঁর ছিল না, তা নয়। কিন্তু অসমের জঙ্গল, মশা, ম্যালেরিয়া সর্বোপরি এই নির্বাসিত জীবন তাকে টানেনি। ফিরে গেছেন নিজের দেশে। পিতামহ বছরে দুই বছরে কয়েক দিনের ছুটিতে দেশে যেতেন। স্বামী-স্ত্রীতে দেখা সাক্ষাৎ, সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া যা কিছু সব তখনই হত।


গত জন্মের রাস্তায়

বিপুলের ডাকনাম পানু। তার খালি তিন বােন—সানু, মানু, ভানু। বিপুল কোন কথা বলল না। বন্ধুনাথ নিজের নিশ্ৰুপ ছেলেকে দেখছিল। এই ঠিক সাড়ে আট বছর বয়স বিদ্যুতের। তার নিজের এখন একচল্লিশ। হাফ-প্যান্টের বাইরে ছেলের দুখানা পা ডগডগাননা লাউডগা হয়ে বেড়ে উঠেছে। ওপরের দিকের চেয়ে নিচের দিকটাই বেশি লম্বা বিপুলের। খেলাধুলােয় দুটো হাঁটুই ছড়ে গেছে ছেলের। বন্ধুনাথ আবার বলল, ট্রেন থেকে নেমে জায়গাটা চিনতে পারবি তাে?


শাকম্ভরীর দ্বীপ

জমকালাে হােটেল বিল্ডিংটার দিকে ভালাে করে তাকিয়ে দেখলাে সুমনা। কতবার এখান দিয়ে যাওয়া-আসা করেছে। সেভাবে লক্ষ্য করে নি। পার্ক স্ট্রিট মানেই ভালাে ভালাে হােটেল, রেস্তোরাঁ। উল্টোদিকের ফুটপাত থেকে এখন দেখছে, কেননা এটাই তার নতুন কর্মক্ষেত্র। সাধারণ একটা অ্যাড ফার্ম থেকে এই যে লিফ্টটা ও পেলাে, এটা ভাগ্য বলতে হবে। এই চাকরিটার দৌলতে এখন থেকে সে মিসেস রডরিগস-এর গেস্ট হাউজে একটা পুরাে স্যুইট নিয়ে থাকতে পারবে। শােবার ঘর, বসবার লাউঞ্জ, সেখানেই কিচেন আর টয়লেট। ইচ্ছে করলে এখনও মিসেস রডরি-এর কাছে খাওয়ার বন্দোবস্তটা রাখতেই পারে। ইচ্ছে করবে কিনা সেটা একটু ভাবতে হবে। কদিন গেলে বলা যাচ্ছে না। শিফ্ট ডিউটি করে তাে অভ্যেস নেই! যে শিটে কাজ করবে সেই শিটের সময়ে লাঞ্চ বা ডিনার হােটেলেই পাবে। ব্যবস্থাটা তার পক্ষে সুবিধের। খানিকটা টাকা জমিয়ে নিয়ে হােটেল ম্যানেজমেন্টের একটা কোর্স করে নেবার খুব ইচ্ছে আছে।


চুপিচুপি বলছি

পার্কটা কেমন নির্জন আর শান্ত না? শুধু গাছের পাতা নড়ার শব্দ আর পাখির ডাক। খানিক আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। ভেজা ভেজা বাতাস। গাছগাছালি জলে ধুয়ে ঝলমল করছে। দুপুরের আকাশ মেঘেভরা। মনে হয়, আরাে বৃষ্টি হবে। সময় আর পরিবেশটা প্রেমের গল্পের জন্য আইডিয়াল। আমি সুযােগটা ছাড়তে চাই না। নিচু গলায় ফিসফিস করে বলব। মাঝেমধ্যে একটু হাসব, বােকা ধরনের হাসি। সামান্য লজ্জাও পেতে পারি। লজ্জা পাব কেন? গল্পের শেষের দিকে একটা চুমুর ঘটনা আছে। সাতষট্টি বছর বয়েসে চুমুর কথা বলতে লজ্জা পাব না?


ঈশ্বরপুত্র

এই শহরে ছােট বড় দ্বীপের মতাে কত যে ভূখণ্ড। কোনওটা চেনা, কোনওটা আধাে-চেনা, কোনওটা বা একেবারেই অচেনা। এইসব ভূখণ্ড নিয়ে বিশাল এক দ্বীপপুঞ্জ যার নাম কলকাতা মেট্রোপলিস। কর্পোরেশনের চৌহদ্দির দক্ষিণ সীমানা ঘেঁষে এমনই একটা দ্বীপ শহরের গায়ে আলগাভাবে জুড়ে আছে। কলকাতার মধ্যেই আছে আবার যেন নেইও। নিরানব্বই বছর আগে সেই ব্রিটিশ আমলে আদমশুমারিতে কলকাতার জনসংখ্যা যখন মেরেকেটে বারাে-চোদ্দো লাখ, সেই সময় বাঙালি খ্রিস্টানদের এই পাড়াটার পত্তন হয়েছিল। নামকরণ কর হয়েছিল ‘নিউল্যান্ড।


মনের মুকুরে কার ছায়া

কলকাতা থেকে প্রায় সাতাশ মাইল দূরে এই বিপুলায়তন বাগানবাড়িটা প্রায় সকলের চোখে পড়ে। চৌত্রিশ নম্বর ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে বহরমপুর, মালদা কিংবা শিলিগুড়ির দিকে পাড়ি দিলে বাগানবাড়িটা ঠিক পথের ধারে না হলেও সামান্য একটু ভিতরে রয়েছে। গাড়ি থেকে অবশ্য বাগানবাড়ির গেট বা প্রবেশদ্বার চোখে পড়বে। কী যেন একটা নাম আছে বাগানবাড়িটার। হ্যা, বলছি সেটা। বাগানবাড়িটার নাম মনােমুকুর অর্থাৎ মনের আয়না বা মনের মুকুর।


গল্প হলেও সত্যি

মােট কথা আমি কখনাে তােকে ছেড়ে থাকতে পারতাম না, তুইও কখনাে আমাকে ছেড়ে থাকতে পারতিস না। তাই তাে কোনােদিন আমার মা আমাদের দুজনকে দু’পাশে নিয়ে ঘুমুতেন ; আবার কোনােদিন নতুন মা আমাদের দুজনকে দু’পাশে নিয়ে শুতেন। এইভাবেই কেটেছে আমাদের ছােটবেলা। একটু বড় হবার পর আমার দাদা আমাদের দু’জনকে নিয়ে পার্কে বেড়াতে যেত। পার্কে গেলে আমরা প্রাণভরে দৌড়াদৌড়ি করতাম, দোলনায় চড়লে দাদা আমাদের দোল দিত। খুব মজা লাগত দোলনায় চড়তে।