বল বীর-
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর-
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
বাংলাদেশে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দে (২৪ মে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে এক সম্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তার পিতা কাজী ফকির আহমদ ও মাতা জাহেদা খাতুন। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি পিতৃহীন হন । এ সময় তিনি জীবিকার প্রয়োজনে “লেটো’র দলে যোগ দেন। কিন্তু বেশিদিন তিনি এ দলে থাকেননি। দশ বছর বয়সে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করার পর তিনি গ্রামের মক্তবে কিছুদিন শিক্ষকতার চাকরি করেন। তারপর তিনি চলে আসেন নতুন কর্মস্থল আসানসোল সেখানে থানার দারোগা জনাব রফিজউদিনের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরে তার সঙ্গে চলে আসেন দারোগার নিজগ্রাম ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দরিরামপুরে। দরিরামপুর হাই স্কুলে। এখানে প্রায় এক বছর পড়ালেখার পর নজরুল পুনরায় চলে যান চুরুলিয়ায়। ভর্তি হন রানীগঞ্জের শিয়ারসোল রাজ স্কুলে। এখানে তিনি পড়াশোনা করেন তিন বছর। এ সময় প্রথম মহাযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। নজরুল তখন প্রবেশিকা পরীক্ষা দেবার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। প্ৰাক-নির্বাচনী পরীক্ষা শেষ হতেই তিনি যুদ্ধে যোগ দিলেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে যোগ দেন। ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে। তিন বছর তিনি সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকেন। তার চাকরিজীবন ছিল মূলত করাচিতে। এ সময় তাকে পেশোয়ার, নওশেরা, বেলুচিস্তান পর্যন্ত যেতে হয়েছে। সৈনিকজীবনে অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি প্ৰথমে হাবিলদার ও উন্নীত হন। করাচির সৈনিক জীবনকে বলা হয় তাঁর প্ৰতিভার সাজঘর । ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়া হলে তার পেশাদারী সৈনিক জীবন সমাপ্ত হয়। করাচিতে চাকরিকালে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম গল্প 'বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ কলকাতার 'সওগাত' পত্রিকায় (জ্যৈষ্ঠ ১৩২৬ সংখ্যা) এবং প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ কলকাতার “বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা’য় (শ্রাবণ ১৩২৬ সংখ্যা) প্রকাশিত হয়। এভাবে প্ৰতিভাধর সাহিত্যিক হিসাবে নজরুলের বাংলা-সাহিত্যে প্রবেশ । যুদ্ধশেষে নজরুল চলে আসেন কলকাতায় এবং পরিপূর্ণভাবে সাহিত্যকর্মে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯২২ বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ প্ৰকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি “বিদ্রোহী কবি’ হিসাবে খ্যাতিলাভ করেন। তার সম্পাদিত অর্ধ-সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশিত হবার পর ইংরেজ সরকার তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। জেলা থেকে মুক্তি পাবার পর তিনি পুনরায় সাহিত্য-সঙ্গীত রচনায় মনোনিবেশ করেন। একে একে নজরুলের কাব্যগ্রন্থাবলি ‘অগ্নি-বীণা’, ‘বিষের বঁাশী’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘প্রলয়-শিখা’ ইত্যাদি প্রকাশিত হয়। সে সঙ্গে তিনি রচনা করতে থাকেন বিচিত্রধর্মী অজস্র গান। তিনি সমাহারে উদ্ভাসিত করে তুলেছিলেন। নজরুলের সাহিত্য-জীবন ছিল মাত্র বাইশ বছরের। এ রচয়িতা, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সাংবাদিক, প্ৰবন্ধকার, গীতি-নাট্যকার, অভিনয়-শিল্পী ও সুরকার। তাঁর সৃষ্টিকর্ম "চল চল চল’ গানটি বাংলাদেশের রণ-সঙ্গীত। নজরুল মাত্র ৪১-৪২ বছর বয়সে এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশের জাতির পিতা প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে। অসুস্থ কবিকে বাংলাদেশে আনা হয়। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডি-লিট ডিগ্রি এবং বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে ‘একুশে পদক' প্ৰদান করা হয়। চৌত্ৰিশ বছর অসুস্থ থাকার পর ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ (২৯ আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ) তিনি পরলোকগমন করেন। তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করা হয়।