সন্ধ্যায় আগেই আজ পৃথিবী অন্ধকার হবে। পশ্চিমের আকাশে এখনও খানিকটা জায়গা জুড়ে অস্তগত সূর্যের বুকের রক্ত-মাথানো আলো ছড়ানো আছে বটে, কিন্তু তার চিহ্নি তাড়াতাড়ি মুছে ফেলবার জন্যে হু-হু করে বিরাট এক কালো মেয়ে ধেয়ে আছে।
পঞ্চাশ বছর আগে, ইংরেজরা তখনও আমাদের বুকের ওপর বসে এদেশে রাজত্ব চালাচ্ছে। এটা সেই সময়ের গল্প। কলকাতা থেকে দু-আড়াই শ মাইল দূরে ঢাকা জেলার এক গ্রামে ছিল আমার মামারবাড়ি। গ্রামটার নাম বাজিতপুর। আমার ছেলেবেলার বেশ ক’টা বছর সেখানে কেটেছে। বাজিতপুর আর তার চারপাশের আরো বাইশখানা গ্রাম নিয়ে ছিল একটি মাত্র থানা । থানাটা ছিল ওই বাজিতপুরেই।
রোগ যেমন রকমারি আছে, তার প্রতিকারও আছে অনেক রকম। আজকাল চিকিৎসার জন্য আগেকার মতো প্রেশক্রিপশন বড় একটা লিখতে হয় না। দোকানে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষাও করতে হয় না ওষুধ তৈরির জন্যে। ওষুধ তৈরিই আছে—পিল, ক্যাপসুল, পেস্ট, ইনজেকশন এইসব। এটা চিকিৎসা-বিজ্ঞানের এক চমকপ্ৰদ কৃতিত্ব, সন্দেহ নেই। কী করে অল্প সময়ের মধ্যে এই সাফল্য এল, সে এক তাজ্জব ব্যাপার।
আজকের দিনে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অদ্ভুত সব আবিষ্কার সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকা কাজের কথা নয়। আকস্মিক দুর্ঘটনা সকলের জীবনেই ঘটতে পারে, ব্যাধিও যে কোনও সময় আক্রমণ করতে পারে। এর প্রতিকারের জন্য ডাক্তার আছেন একথা সত্যি। কিন্তু ডাক্তার তো আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে পারেন না! কাজেই ব্যাধির প্রারম্ভিক চিকিৎসা, কোন রোগের কোন ওষুধ এটা মোটামুটিভাবে আমাদের অল্প বয়স থেকেই জানা দরকার।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের আজব কাহিনীগুলি এই বইতে কিশোর বয়স্কদের জন্য গল্পের মতো করে লেখা হয়েছে।
এই বইখানি লিখতে আমার পিতা এবং পিতৃবন্ধু অধ্যাপক ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচাৰ্য আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন। সেজন্য আমি তাঁদের কাছে বিশেষভাবে ঋণী।
এখানকার হাওয়ার যেন ভয়ঙ্কর দাঁত আছে, শরীর কামড়ে ধরে একেবারে। সন্তু কাকাবাবুর সঙ্গে একবার কাশ্মীরেও গিয়েছিল, কিন্তু সেখানকার শীতের সঙ্গে এখানকার শীতের যেন তুলনাই হয় না। হওয়ার ভয়ঙ্কর দাঁত আছে, এ কথাটা সন্তুরই মনে পড়েছিল। গরম জামা- কাপড় দিয়ে শরীরের সব জায়গা ঢাকা যায়,
রায়বাড়ির বাগান-গাছপালা সকালের সোনা রোদে ঝিকমিক করছে। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবা একদৃষ্ঠে তাকিয়ে আছে পাশের ছাদের কার্নিশের দিকে। নিচের লনে হঠাৎ ছুটোছুটি জুড়ে দিয়েছে শিম্পাঞ্জি ‘কেলো’, অ্যালসেশিয়ান ‘রাজা’ আর ভালুক ‘বালু’। তাদের দিকে তাকিয়ে মিনি ও পুষি বেড়াল দুটোও নানান সুরে একনাগাড়ে ডেকে চলেছে।
সত্যিকথা স্বীকার করতে দোষ নেই। উপন্যাস লেখা আমার কর্ম নয়। সেই ধৈৰ্য, সেই ক্ষমতা আমার নেই। শুধু মাত্র কিশোরদের জন্যে কেন, বড়দের জন্যে কোনো উপন্যাস লেখার কথা ভাবলে আমার গায়ে জ্বর আসে, আমার ডানহাতের তর্জনীতে আঙুলহারা হয়। তবু মেরেকেটে মাপজোক করে ছোটেদের জন্যে ছয়টি আখ্যায়িকা রচনা করেছিলাম, যেগুলো খুব বড় না হলেও সাধারণ গল্পের চেয়ে বড়, যেগুলোর হেরফের আছে, দিগ্বিদিক আছে। এগুলো নিশ্চয় উপন্যাস নয়, উপন্যাসিকা। এর অধিকাংশ আনন্দমেলার প্রাতঃ-স্মরণীয় সম্পাদক নীরেন্দ্ৰনাথ চক্রবর্তী আমাকে গলায় গামছা বেঁধে লিখিয়েছিলেন। তাকে উৎসর্গ করলাম। এই উপন্যাস সমগ্ৰ। - ১ লা বৈশাখ, ১৪০১
দুপুরে সের খানেক চালের ভাত । সেই সঙ্গে আস্ত একটা মাছের মুড়ো, দেড়সের পাঁঠার মাংস, নানারকম তরকারি আর প্রকাণ্ড এক বাটি দই । কে যেন তাকে বলেছিল সোনা থেলে শক্তি বাড়ে। তাই গয়নার দোকান থেকে খানিকটা সোনা পিটিয়ে কাগজের মতো পাতলা করে এনেছিল নগেনমামা। বিকেলে তিনপো ক্ষীরের সঙ্গে এক কুচি সোনার পাত থেয়ে ফেলত।
দুয়োরাণী শিকড় বাটিতে বাটিতে কতকটুকু নিজে খাইয়া ফেলিলেন। তাহার পর, রূপার থালে সোনার বাটি দিয়া ঢাকিয়া, বড়রাণীর হাত দিলেন। মেজরাণী খানিকটা খাইয়া, সেজরাণীকে দিলেন। সেজরাণী কিছু খাইয়া কনেরাণীকে দিলেন। কনেরাণী বাকীটুকু খাইয়া ফেলিলেন।
বাড়ি থেকে বেরিয়েই কাকাবাবু শুনতে পেলেন একটা কোকিলের ডাক। এখন সকাল সাড়ে পাঁচটা। ঠিক সকালও বলা যায় না, ভাল করে ভোরই হয়নি, আলোর সঙ্গে মিশে আছে খানিকটা অন্ধকার। কাকাবাবু দাঁড়িয়ে একটুক্ষণ কোকিল আছে, মাঝে মাঝেই তাদের ডাক শোনা যায়।
বাঙ্গালীর বুক হাসির স্বর্গ। বাঙ্গালীর ভাষা রামধনুর দেশ। বাঙ্গালার কথাসাহিস্য সে স্বর্গ আর রং-ধনু এ দুটিকে জীবন ও আনন্দের অজস্র শ্রাবণে গলাইয়া, ছড়াইয়া দিয়াছিল দেশময় পুষ্পবৃষ্টির মত।
বইটার নাম 'ক্ষীরের পুতুল'। লেখক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পাতায় পাতায় ছবি। 'ক্ষীরের পুতুল' হচ্ছে আমার প্রথম-পড়া 'সাহিত্য'। সাহিত্যের প্রথম পাঠ আমি আমার বাবা-মা'র কাছ থেকে পাইনি। বাবার বিশাল লাইব্রেরি ছিল। সেই লাইব্রেরির পুস্তকসংখ্যা মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো। সমস্ত বই তিনি তালাবদ্ধ করে রাখতেন। বাবার লাইব্রেরির বই আমাদের অর্থাৎ বাচ্চাদের নাগালের বাইরে ছিল। বাবা হয়তো ভেবেছিলেন, এসব বই পড়ার সময় এখনও হয়নি। শুক্লাদি তা ভাবেননি। তিনি অসাধারণ একটি বই একটি বাচ্চা-ছেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে তার স্বপ্নজগতের দরজা খুলে দিলেন। স্বপ্নজগতের দরজা সবাই খুলতে পারে না। দরজা খুলতে সোনার চাবির দরকার। ঈশ্বর যার-তার হাতে সেই চাবি দেন না। সে চাবি থাকে অল্পকিছু মানুষের কাছে। শুক্লাদি সেই অল্পকিছু মানুষদের একজন। ...বাসায় এসেই বসেছি ক্ষীরের পুতুল নিয়ে।
রুবিকে নিয়ে কাহিনী তৈরি হয়েছে। বইটি বাংলারই বীরভূমকে পটভূমি করে লেখা। গল্পটি যার পূর্বপুরুষের পান্নাকে (রুবি) নিয়ে, সেই রবার্টসনের সাথে ফেলুদাদের প্রথম পরিচয় হয় বীরভূমে যাওয়ার ট্রেনে, যা পরে সখ্যে গড়ায়। ভারতপ্রেমী রবার্টসন তার আলোকচিত্রী বন্ধু টম ম্যাক্সওয়েলকে সঙ্গে নিয়ে বীরভূম যাচ্ছিলেন পোড়ামাটির স্থাপত্যকলার স্থানীয় কিছু নিদর্শন দেখতে। তবে তার কাছে যে ভারত থেকে তারই ব্রিটিশ পূর্বপুরুষের লুঠ করা এক বহুমূল্য পান্না আছে, আর তা যে তিনি ভারতে ফেরত দিতে এসেছেন, সে খবর চাউর হয়ে যাওয়ায় অনেকেরই অনাকাঙ্খিত নজর পড়ে তার উপর।
মার্চ থেকে জুন পেরুর হাজার হাজার তীর্থযাত্রী কুজকোয় যায় বরফ-ঢাকা পাহাড় পেরিয়ে। সেখানে েএক জায়গায় এরা পার্থনা করে। এই তীর্থযাত্রা রেড় ইন্ডিয়ান আর খ্রিস্টীয় প্রথার সংমিশ্রণ। এদের মধ্যে উকুকু জাতির মানুষ ফিরে আসে বরফের চাঙড় নিয়ে - রোগ সারাবে বলে।
বাপ-মা হারা কিশোর নাগা। মাঝির ছেলে। নিদারণ অভাবের সঙ্গে প্রতিমুহূর্তের লড়াই। বলিষ্ঠ শরীর, দুচোখে স্বপ্ন। নাগা স্বপ্ন দেখে, সে সমুদ্রে যাবে। তারপর? চাকরি মেলে, বড়মানুষ যাদববাবুর নৌকায়। একদিন যাদববাবু লঞ্চ কিনলেন। লঞ্চ পাড়ি দেবে সাগর। নাগার দুচোখে ঢেউয়ের ঝিলিক-এবার স্বপ্ন সত্যি হবে। লঞ্চে সঙ্গী হয় নাগা। কিন্তু যাদববাবু দেনার দায়ে তখন বিপর্যস্ত, বে-আইনি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। সে এক দু:স্বপ্নের রাত। ভয়ানক ঝড়-জল। পায়ে দাঁড়িয়ে পুলিশবাহিনী। তারা খবর পেয়ে গেছে। নিরুপায় হয়ে লঞ্চের মুখ ঘুরল সমুদ্রের দিকে। নিচের কেবিনে অন্যরা। ডেকে দাঁড়িয়ে একা নাগা। প্রবল ঝড়, দৈত্যের মত ঢেউ আছড়ে পড়ছে। তারপর? রোমাঞ্চ-টানটান এই উপন্যাসটিই কালজয়ী কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একমাত্র সম্পূর্ণ কিশোর উপন্যাস।
প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শুঙ্কুর ডায়রিটা আমি পাই তারক চাটুজ্যের কাছ থেকে। একদিন দুপুরে দিকে আপিসে বসে পুজো সংখ্যা জন্য একটা লেখার প্রুফ দেখছি, এমন সময় তারকবাবু এসে একটা লাল খাতা আমার সামনে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘পড়ে দেখো । গোল্ড মাইন।’
বাংলা কল্পবিজ্ঞান কাহিনীর আসরে স্কটিশ চার্চ কলেজের অধ্যাপক ত্ৰিলোকেশ্বর শঙ্কুর আবিৰ্ভাব উনিশশো একষট্টি সালে। ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পাতায় প্রথম বেরুল ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’। লেখক সত্যজিৎ রায়। সেই শুরু। সূচনালগ্ন থেকেই শঙ্কুকাহিনী কিশোর পাঠকদের মন জয় করে নিল। প্রথম কাহিনীতে ডায়রির আকারে প্রোফেসর শঙ্কু নিজেই বলেছেন নিজের কাহিনী। তারপর থেকে শঙ্কুর আটত্রিশটি সম্পূর্ণ এবং দুটি অসম্পূর্ণ ডায়রি প্রকাশিত হয়েছে উনিশশো বিরানব্বই পৰ্যন্ত। এই তিরিশ বছরে শঙ্কু স্বয়ং এবং তাঁর কাহিনী ছোটদের কাছে সেরা আকর্ষণ।
এই বৈজ্ঞানিক ও আবিষ্কারক মানুষটি খাঁটি বাঙালি। ভয়ঙ্কর অভিযানে তিনি অকুতোভয়, অথচ আত্মভোলা। আবার আশ্চৰ্য সংযমী। তাঁর কর্মক্ষেত্র কলকাতা হলেও গবেষণাক্ষেত্র বিহারের গিরিডিতে। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীমহলে তিনি সসম্মানে গৃহীত হয়েছেন। তাঁর আত্মপ্রত্যয় ও বিচিত্র উদ্ভাবনী প্ৰতিভা বিস্ময়কর।
প্রোফেসর শঙ্কুর আবিষ্কারের পদ্ধতি যেমন বিচিত্র, তেমনই অদ্ভুত সেইসব আবিষ্কারের নাম। অ্যানাইহিলিন, মিরাকিউরল, নার্ভিগার, অমনিস্কোপ, স্নাফগান, ম্যাঙ্গোরেঞ্জ, ক্যামেরাপিড, লিঙ্গুয়াগ্রাফ ইত্যাদি। এদের কোনওটি ওষুধ, কোনওটি যন্ত্র, কোনওটি বা অন্ত্র কিংবা গ্যাজেট। শঙ্কুর জগতে প্রাকৃত ও অতিপ্রাকৃতের দারুণ সহাবস্থান।
গবেষণা ও আবিষ্কারের সূত্রে শঙ্কু বিশ্বভ্রমণ করেছেন। তিনি ‘সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স কর্তৃক সম্মানিত’। এই ‘বিশ্ববিখ্যাত’ চরিত্রটিকে নিয়ে সত্যজিৎ রায় যেসব আশ্চর্য কাহিনী রচনা করেছেন, তাকে শুধু ‘সায়েন্স ফিকশন’ বা কল্পবিজ্ঞান কাহিনী বললে সবটুকু বলা হয় না। কল্পবিজ্ঞান তো অবশ্যই, একই সঙ্গে এই কাহিনীগুলিতে মিশে আছে ভ্ৰমণ, রহস্য ও অ্যাডভেঞ্চার রস। আবার দুরন্ত অভিযান, অতীন্দ্ৰিয় পরিপার্শ্ব, ফ্যান্টাসি ও রোমাঞ্চের মিশ্রণে গল্পগুলি জমজমাট।
শকুকাহিনীর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, এই কাহিনীগুলির জগতে ঢুকে ছোট-বড় নির্বিশেষে সকল পাঠক যেন একবয়সী হয়ে ওঠে। সমস্ত কাহিনী একটি খণ্ডে গ্রথিত করে এবার প্রকাশিত হল শঙ্কুসমগ্ৰ৷ এই সংকলনে সংযোজিত হল সত্যজিৎ রায়ের আঁকা বেশ কিছু ছবি—যা এর আগে গ্রন্থাবদ্ধ হয়নি।
তখন শীতকাল -- নভেম্বরের শেষ। রাত্রি। ডােভারগামী রাজপথ দিয়ে একখানি ডাকবাহী ঘােড়ার গাড়ি চলেছে। সম্মুখে একটি ছােট পাহাড়। নাম সুটার-পাহাড়। পথ গেছে তার ওপর দিয়ে। তাই সেখানে। চড়াই। তার ওপর হাঁটু সমান কাদা; গাড়িখানিও মাল-পত্রে বােঝাই। সেজন্য কোচম্যান ও যাত্রী কয়েকজনকে নেমে গাড়ির পাশে পাশে। চলতে হচ্ছে। তখন দিন-সময় এমন যে দেশে রাজা থাকলেও নগরে ও গ্রামে শান্তি-শৃংখলা ছিল না। অরাজকতা, চরি, ডাকাতি, রাহাজানি, খুন লেগেই ছিল। কে যে সৎ, কে যে দস্যু তা বােঝা ছিল কঠিন। কারণ, যে দিনে শান্তিরক্ষক সেই হয়তাে রাত্রে ডাকাতি করতাে, মানুষ খুন করতেও তার বাধতাে না। দেশের এই রকম অবস্থার মধ্যে সেই ডাকগাড়িখানি ডােভারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাই তার কোচম্যান, রক্ষী, যাত্রী।
এ কথা আজ বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সত্যজিতের প্রধান সৃষ্টির জগৎ চলচ্চিত্রের জগৎ । এখানে তাঁর সিদ্ধি বিশ্বমানের এবং আবিস্মরণীয়। এমন একজন স্রষ্টা যখন সাহিত্যসৃষ্টিতেও শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠেন, তখন আমাদের বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে লক্ষ করি সিনেমার সঙ্গে তিনি সাহিত্যভাবনাতেও ব্যাপ্ত হয়েছিলেন। মগ্ন হয়েছিলেন অন্য এক দিগন্ত রচনায়। বাংলা দেশের এক সম্মানিত সাহিত্যভবন ও সাহিত্যপরিবারের ঐতিহ্য ছিল সত্যজিতের রক্তে। এর সঙ্গে মিশে গিয়েছিল তাঁর প্রতিভা, মেধা, ব্যক্তিস্বতন্ত্র্য, কল্পনা, উদ্ভাবনী মন আর অকৃত্রিম গদ্যশৈলী। গল্প রচনার সূচনালগ্ন থেকেই সত্যজিৎ পাঠকের মন জয় করে নিয়েছিলেন। শুরু থেকেই তিনি লিখেছেন গল্পের মধ্যে জমাটি গল্প। এদিক থেকে বোধ হয় তিনি স্যার ফিলিপ সিডনির তত্ত্বে বিশ্বাসী। সর্বপ্রথমে যা গল্প, সব শেষেও তা গল্প। কোনও জটিল তত্ত্ব নয়, ছোটগল্পে তিনি খুঁজে নিয়েছেন মুক্তি ও বিস্ময়। সুধী সমালোচকের ভাষায়, “আমাদের খণ্ডিত অস্তিত্বের সমস্যাসন্ধুল জগৎটা সেখানে মাথা চাড়া দেয় না। তার বদলে পাই মহাকাশের সংকেত, অতল সমুদ্রের ডাক, মরু বা মেরুর ইশারা অথবা মানুষের, একান্তই ছাপোষা সাধারণ মানুষের অশেষত্বের ঠিকানা। প্রযুক্তি পারঙ্গম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে যে-মানুষের গল্প তিনি শোনান সে-মানুষ গাণিতিক সিদ্ধির জগতে গণিতের অতীত মানুষ।” জগৎ ও জীবনকে সত্যজিৎ এমনই শিল্পীস্বভাবে দেখেছেন আগাগোড়া। ফলে তাঁর গল্পের কিশোরপাঠ্য ও বয়স্কপাঠ্যের বিভাজন রেখা মুছে গেছে। অনায়াসে। সব বয়সী পাঠককে তাঁর গল্পের জগতে সত্যজিৎ টেনে আনতে পেরেছেন। এই সিদ্ধি ও কৃতিত্ব খুব কম সংখ্যক গল্প-লেখকেরই আছে। সময়জয়ী এই গল্পগুলি যে-ভাষায় সত্যজিৎ লিখেছেন তা একান্তভাবে তাঁর নিজের ভাষা। তাঁর গদ্যশৈলী অননুকরণীয়। “এ গদ্যে কোথাও ফেনা নেই। পাতাবাহার নেই। নিম্পত্র অথচ ফলবতী লতার মতো মনোজ্ঞ সে গদ্য।” আবার শব্দ দিয়ে তৈরি করেছেন ছবি। প্রয়োজন মতো সে-ছবিতে রং ধরিয়ে চাক্ষুষ করেও তুলেছেন। সত্যজিতের আশিতম জন্মবর্ষপূর্তিতে শঙ্কু ও ফেলুদার কাহিনীগুলি বাদ দিয়ে তাঁর সমস্ত গল্প, দুটি উপন্যাস ও একটি নাট্যকাহিনী নিয়ে একত্রে প্রকাশিত হল ‘গল্প ১০১’ ।
কাশীবাবু সকালে তাঁর বাগানে গাছপালার পরিচর্যা করছেন। সঙ্গে তাঁর বহুকালের পুরনাে মালি নরহরি। নরহরি শুধু মালিই নয়, সে বলতে গেলে অনেক কাজের কাজি। তবে সে ভারী ভিতু লােক, দুনিয়ার সব কিছুতেই তার ভয়। দিনেদুপুরে একটা গােলাপ ডালের ন্যাড়া মাথায় গােবরের টুপি পরাতে পরাতে হঠাৎ সে বলে উঠল, “হয়ে গেল! ওই এসে পড়েছে। আর উপায় নেই কর্তামশাই, সব চেঁচেপুঁছে নিয়ে যাবে।”
মজা হল, আমি কাউকে ডেকে এনে খাতির করে বসাই না, তারা সব গন্ধে গন্ধে আপনি আসে। এই ভূতপ্রেত, বিটকেল আর খিটকেলে লােক, উজবুক আর ভবঘুরে, বােকা আর চালাক, নানা সাইজের দারােগাবাবু, এমনকী রাজাগজা অবধি এসে আমার লেখার পাতায় গাট হয়ে বসে যায়। আর নিশুত রাতে তাদের সঙ্গেই আমার তুমুল আড্ডা জমে ওঠে। আমার যে বুড়াে মাস্টারমশাই উবু হয়ে বসে ছেলেবেলায় আঁক কষাতেন তিনিও দেখছি হাজির হয়ে গেছেন। আর আকাশের অনেক তফাতে গ্রহান্তরের মানুষজনও সাঁ সাঁ করে নেমে পড়েন। আসেন কাপালিক, মাথা পাগলা লােক, পেটুক, হাড়কৃপণ, আনমনা ভুলাে মনের মানুষ। চোর-ডাকাতের কথা তাে বলাই হয়নি, আর চোরও কি একরকম? হরেক চোর, হরেক ঘটনা, ডাকাতদের সঙ্গেও আমার ভারী খাতির। খারাপ লােকদেরও তাে ফেলতে পারি না।
ছোটদের জন্যও যাঁরা কলম ধরেছেন, তাঁদের মধ্যে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের নাম নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য । আরও উল্লেখ্য এই কারণে যে, কিশোর-রচনায় তিনি শুধু ঘটাননি, একই সঙ্গে ছোটদের . পরিবর্তনের কথাও ভেবেছেন । নিছক হাসিঠাট্টার উপাদান ছোটদের ক্ষেত্রে তাঁর উপজীব্য নয় । অল্প বয়স থেকেই ছোটরা যাতে বড় হবার, মানুষ হবার প্রেরণা পায়-তাঁর লেখার মধ্যে সেই দিকটার দিকেই নজর বেশি । আগুনে না পোড়ালে যেমন সোনা হয় না, তেমনি দুঃখ-কষ্টভরা বাস্তব জগতের অভিজ্ঞতা ছাড়াও মানুষ খাঁটি মানুষে পরিণত হতে পারে না । কিশোর-উপন্যাসে এই সত্যটিকেই যেন তুলে ধরেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। যেমন, এই ‘ইতি তোমার মা” । বিচিত্র ঘাত-প্ৰতিঘাতের মধ্য দিয়ে এক প্রতিকূলতাকে কীভাবে জয় করতে শিখল, তারই এক গভীর, মর্মস্পশী কাহিনী এই উপন্যাস । সত্য, ধর্ম ও পৌরুষের চূড়ান্ত জয়ের এক অপ্রতিম আলেখ্য ।
গবাক্ষবাবু মুখে একটা দুঃখসূচক চুক চুক শব্দ করে বললেন, “পয়সাটা বৃথাই গেল রে। গাঁ-গঞ্জের মানুষ কি আর এত ভাল নামের কদর বুঝবে? উচ্চারণই করতে পারবে না।”
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে মােলায়েম গলাটা বেশ ক্ষোভের সঙ্গেই বলল, “গাঁয়ের লােকের উশ্চাটনের কথা আর বলবেন না মশাই। উশ্চাটন একেবারে যাচ্ছেতাই। আগে পঞ্চা-পঞ্চা করত, এখন পেড়াপেড়ি করায় বদু বদু বলে ডাকে। প্রিয়ংবদ উশ্চাটনই করতে পারে না।”
ছােটদাদু বদনকে এবার সঙ্গে করেই নিয়ে এলেন। সারা রাস্তায় বদন শুনেছে, ছােটদাদু কেবল বিড়বিড় করে বকছেন। তার বাবাকে গালমন্দ করছেন। সকালে বের হয়েছিল তারা। মা চিড়া-গুড় পুঁটুলিতে বেঁধে দিয়েছিল। নদীর পাড়ে বসে দাদু আর সে চিড়া-গুড় খেয়েছে। দাদু নদীর জলে ডুব দিয়ে আহ্নিক সেরেছেন। ভিজা কাপড়েই বসেছিল দু’জনে মুখােমুখি। চিড়া-গুড় জলে ভিজিয়ে নদীর পাড়ে বসে খাওয়ার মজা, সে প্রথম টের পেয়েছিল।