‘চণ্ডীমণ্ডপ’ এবং ‘পঞ্চগ্রাম’ উপন্যাসে তারাশঙ্কর কালান্তরের এক নূতন দেবতাকে আবাহন করেছেন। এ দেবতা বিষ্ণুও নন; শিব নন; এ দেবতা গণদেবতা। পৌরাণিক গণদেবতা অর্থাৎ আদিত্য, বিশ্ব, বসু, তুষিত, আভাস্বর, অনিল, মহারাজিক, সাধ্য, রুদ্র,—এই নয়জন দেবতার সমষ্টিও নয়। তারাশঙ্করের গণদেবতায় পৌরাণিক দেবতা নেই, আছে অনিরুদ্ধ, পাতু, শ্ৰীহরি, দুর্গা, দেবু, পদ্ম। এরা দেবতা নয়, মানুষ। আত্মকেন্দ্ৰিক একক মানুষ নয়, গোষ্ঠীকেন্দ্ৰিক সামাজিক মানুষ। গোষ্ঠীজীবনের গণশক্তিতে যে-দেবতার রথের চাকা চলে তিনি গণদেবতা। চণ্ডীমণ্ডপ এই গণদেবতার বিগ্ৰহ। অপেক্ষাকৃত আধুনিককালে ‘গণশক্তি’ এবং ‘জনগণ' কথাগুলির রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা আছে। কিন্তু তারাশঙ্কর গণদেবতা বলতে যা বুঝেছেন তা সামাজিক institution। তার অতিরিক্ত কিছু নয়। চণ্ডীমণ্ডপের সমাজ-শাসনের অন্যায়-অবিচারের সমালোচনা তিনি করেননি, এমন কি চণ্ডীমণ্ডপের শাসনশক্তির উপর তেমন প্রচণ্ড রকম গুরুত্বও তিনি আরোপ করেননি। চণ্ডীমণ্ডপের শাসন যে অস্বীকার করেছে সেও চণ্ডীমণ্ডপের বহির্ভূত নয়। চণ্ডীমণ্ডপের গোষ্ঠীসমাজের বিরুদ্ধে ব্যক্তি-বিবেকের বিদ্রোহের ইঙ্গিতও তারাশঙ্কর দেননি। ‘গণদেবতা’য় তারাশঙ্কর দেখিয়েছেন, চণ্ডীমণ্ডপকে আশ্রয় করে ব্যষ্টিজীবন গোষ্ঠীজীবনে পরিণত হয়েছে। চণ্ডীমণ্ডপ-আশ্রিত গোষ্ঠী জীবন এবং গোষ্ঠীজীবনের বিলয়, উগ্র ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের উদ্ভব, শহরকেন্দ্ৰিক নূতন সামাজিক institution এর আবির্ভাব, agricultural economy-র পরিবর্তে industrial economy-র প্রাধান্য-বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বাঙালী জীবনের যুগান্তরের এই ইতিহাস ধরা পড়েছে তারাশঙ্করের গণদেবতা পরিকল্পনায়। সে বিচারে ‘গণদেবতা’ এবং ‘পঞ্চগ্ৰাম’ একালের বাঙালীর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের ভাষ্য। বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের মানুষের জীবন সোজাও নয়, বাঁকও নয়, ত্রিভুজাকৃতি। রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজ সে ত্রিভুজের তিনটি বাহু। তারাশঙ্করের অনেক চরিত্র ত্রিভুজাকারের। সেটি তার ইতিহাস-চেতনার লক্ষণ। এবং এই কারণে ইতিহাসের পদক্ষেপের চিহ্ন পড়ে তারাশঙ্করের ‘পঞ্চগ্ৰাম’ এপিক লক্ষণাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। বিষয়গৌরবে এই দুখানি উপন্যাসের শ্রেষ্ঠত্বের কথা স্বীকার করেই বোধ হয় ‘গণদেবতা’কে এ যুগের মহার্ঘ্যতম সাহিত্য-পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল