বৃষ্টি পতনের শব্দ গাছপালার মধ্যে একরকম, টিনের চালে একরকম। আর পুকুরের জলে একেবারে আলাদা। এই শব্দের মধ্যে আদিনাথের উচ্চারিত মন্ত্র তাঁর অভীষ্ট দেবতারা কীভাবে শুনতে পাবেন কে জানে? এখন বরুণদেবেরই একচ্ছত্র অধিষ্ঠান। কিন্তু তাঁর নামে কোনও শ্লোক এখানকার কারও জানা নেই। দেবতারা বহু দূরে থাকেন, সেইজন্যই বােধহয় আদিনাথ মন্ত্রোচ্চারণ করেন খুব জোরে জোরে। অথবা তিনি নিজের কণ্ঠস্বর শুনতে ভালবাসেন।
পয়সা যখন আছে, কেন করব না। কিন্তু পয়সায় তাে আর নামকরা স্কুলের দরজা খুলবে না। সে অনেক হ্যাপা। শুনেছি শিশু যখন মাতৃজঠরে ভূণের আকারে গর্ভসলিলে হেঁটমুণ্ড, উর্ধ্বপচ্ছ, তখনই নাকি ভাল স্কুলের ওয়েটিং লিস্টে নাম লেখাতে হয়। স্ত্রীর কানের কাছে চীৎকার করে ইংরেজি বই পড়তে হয়। পুরনাে দিনের লেখকের লেখা চলবে না। হাল আমলের লেখক চাই। আমেরিকান লেখক হলে ভাল হয়। গাের ভাইডাল, সল বেলাে, স্টেইনবেক। স্ত্রী ডাকলে হাঁ বলা চলে না। বলতে হবে ইয়েস! এমন কিছু বই পড়ে শােনাতে হবে যাতে ইয়াঙ্কি স্ল্যাং আছে। হ্যারল রবিনস, হেডলি চেজ।
অমৃতসর মেলে আপাতত তাদের গন্তব্য লখনউ। সেখানে কয়েকদিন বিরতি দিয়ে অতঃপর তারা পাড়ি দেবে মহান হিমালয়ের গহন গভীরে, ঘুরে বেড়াবে লক্ষ্যহীন, উদ্দেশ্যহীন, আবিষ্কার করবে স্বর্গীয় সুষমায় আপ্লত বরফে-ঢাকা অজস্র সব পর্বতশৃঙ্গ, ওতপ্রােত হয়ে থাকবে চমক দেওয়া বিচিত্র পাহাড়ি-পথ আর সার সার দেশলাই বাক্সের মতাে পাহাড়ের গায়ে সেঁটে থাকা অচিন লােকালয় আর দোকানপার্টের রহস্য উন্মােচনে, তারপর ফিরে এসে কলকাতার জটিল যন্ত্রণায় পুনর্বার ডুব দেবে পাহাড়ের জীবনযাপনের স্মৃতিতে রােমস্থিত হতে হতে। ট্যুর প্রােগ্রামটা এ ভাবেই ছকেছে সায়ন, অনেকদিন ধরেই বলছিল, চলাে গার্গী, ভীষণ এজস্টেড লাগছে, এখন কিছুদিন হিমালয়ের নিভৃত কোনও আস্তানা ছাড়া পরিত্রাণ নেই।
যাহাকে অন্ধকার মধ্যে আলাে বলিয়া জানিত—অন্য আপন কেহ না থাকা সত্ত্বেও যে ভাইটিকে পাইয়া তাহার আর অভাব মনে হইত না—যাহাকে সে প্রাণ অপেক্ষাও ভালবাসে, সে তাহার ভাই নয়। সে তাহার কেহই নয়। তাহার সহিত কোন সম্পর্কই নাই। সে ভালবাসাতেও তাহার অধিকার নাই। এ সংসারে মালতী অনাথা বালিকা, রমেশের ন্যায্য স্নেহের সামগ্রী নহে, তাহাতে তাহার জোর নাই, তাহার কৃপা-ভাজন আশ্রিত মাত্র। হয়তাে এই সকল কারণেই তাহার হৃদয় ব্যথিত হইল, কিন্তু এত কথা তাহার মনে আসে নাই; কেন যে তাহার কষ্ট, কষ্টের কথা রমেশ কি বলিলেন, সে তাহা বুঝিল না, অথচ অকারণে কি একটি মর্মভেদী তীব্র-যাতনায় তাহার হৃদয় আলােড়িত হইয়া উঠিল।