Categories


রচনাসমগ্র ২য় খণ্ড

করখানায় জানাজা নমাজ পড়ার সময় হাত পা ধুয়ে বসার জন্যে এই পুকুর কাটানাে হয়েছিল একদিন। এখন অযত্নে পড়ে থাকা এই ভাঙা ঘাট, শ্যাওলা ঢাকা পুকুর যে কোনাে স্মৃতিভারাক্রান্ত মানুষের মন আরও ভারী করে তুলবে। পৃথিবীতে আমরা আসি অল্পদিনের জন্যে। একদিন যাব—চলে যাব—যেতেই হবে—এই ভাবনায়, ভয়ে নানাভাবে আমরা মৃত্যুর পরেও নিজেকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। সেজন্যেই স্মৃতি, স্মৃতিসৌধ, মঠ, ফলক।


দ্রৌপদী

নয়নের বসবার ঘর দুইভাগে বিভক্ত। একপ্রান্ত জলপাই, আরেকপ্রান্ত সাদা। কার্পেট, দেয়ালের রং, বাতির শেড—সব ম্যাচ করা। জানালার বাইরে উঁকি মারছে জারুলের বেগুনি স্তবক। নিখুঁত আন্তর্জাতিক রুচিতে সাজানাে পরিবেশ, কোথাও বাহুল্য ছন্দপতন নেই। এ ঘরে ঢুকলে এটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে এ বাড়ির গৃহকর্তা-গৃহকত্রী পরম সুখ আর সমঝােতার বন্ধনে আবদ্ধ। হয়ত আসলে তাই-ই। এবং আজকের মৃত প্রেম বুকে না থাকলে, সে সম্ভাবনাকে আমি হয়ত ঈর্ষাই করতাম।


গল্পসমগ্র -২য়

তখনই কিন্তু গঙ্গার দিকে না গিয়ে আমি ওঁকে নিয়ে কেল্লার দিকে রাস্তা ধরে আরও একটু হাঁটলাম । হাওয়া ক্রমশ প্রবল হচ্ছে। বেশ শীতের শিরশিরে ভাব। উনি শালটা ভালােভাবে জড়িয়ে নিলেন শরীরে। আপনমনেই বললেন, কলকাতায় আছি, অথচ এতখানি সময় আমার নিজস্ব, এটা যেন ঠিক বিশ্বাসই করতে পারছি না। কলকাতায় অভিযােগ অনেক বেশি থাকে।


খুঁজে ফিরি কুন্ডলিনী

হবার সময় এ নাম বলতে হেডমাষ্টার বললেন, এ নামটা ভাল নয়, তাের ভাল নাম কি জেনে আয়। বাড়ি ফিরে দেখি পিসিমা পড়ছেন শ্রীমদ্ভাগবত। পিসিমাকে জিজ্ঞাসা করলাম, পিসিমা আমার ভাল নাম কি? তিনি তখন বােধহয় পড়ছিলেন সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম-স্বরূপের কথা। না ভেবে, না চিন্তে বলে দিলেন, যা, বলগে সচ্চিদানন্দ। দুটো নামের সঙ্গেই জুড়ে গেল স্বামিজী স্বামিজী গন্ধ, ধর্ম ধর্ম ভাব। ভাগ্যের প্রহসন আর কাকে বলব! আমার প্রথম প্রকাশক আমার ডাক নামে বই ছাপালেন। সেই থেকে আমি নিগুঢ়ানন্দ’ হয়ে আছি।


শাংগ্রিলার খোঁজে

সবকিছু ঠিকঠাক ছিল, কিন্তু সমস্যা হল চিনা লামাটিকে নিয়ে। এইরকম অভিযানের জন্য যে শারীরিক উদ্যম আর মানসিক সংকল্প লাগে, তা তার ছিল না ; ব্রিটিশ সরকারের দাক্ষিণ্যে বেমওকা প্রমােদভ্রমণ মনে করেই বেরিয়েছিল সে। তিব্বতে ঢােকার পর বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর খােলসের থেকে বেরিয়ে এল এক পানাসক্ত লম্পট। কিন্টুপের সঙ্গে প্রভুর মতােই আচরণ করতে লাগল,


কর্নেল সমগ্র ৭

হােটেল দ্য লেক ভিউ-এর ব্যালকনি থেকে বাইনােকুলারে সেই সেক্রেটারি বার্ডটিকে খুঁজছিলাম। সারস জাতীয় এই দুর্লভ পাখিকে বাংলায় বলা হয় কেরানি পাখি। কারণ, সহসা দেখলে মনে হয়, তার কানে যেন কলম গোঁজা আছে। কাল বিকেলে হ্রদের তীর থেকে পাখিটাকে কয়েক মুহুর্তের জন্য দেখেছিলাম। বিস্তীর্ণ এই প্রাকৃতিক জলাশয়ের মধ্যিখানে একটা জলটঙ্গি আছে। সেখানে ঘন জঙ্গল। পাখিটা একলা, নাকি তার সঙ্গী বা সঙ্গিনী আছে জানি না। তবে সে অতিশয় ধূর্ত তাতে কোন সন্দেহ নেই। এমন একটা দুর্গম জঙ্গলে সে তার ডেরা বেছে নিয়েছে।


কর্নেল সমগ্র ৫

গাড়ির চাকা এতক্ষণে গড়াল। নীপার মনে হল, স্টার্ট দিয়ে থেমে বীতশােক কী যেন ভাবছিল। গাড়িটা পুরনাে মডেলের অ্যাম্বাসাডর। কিন্তু পৌরাণিক বীরদের মতাে স্থিতধী এবং দার্শনিকও। নীপার এইরকম মনে হয়। সে সােমনাথের আঁতলামিকে ব্যঙ্গ করে। অথচ কোনও-কোনও সময়ে সে নিজের চিন্তায় আঁতলামি লক্ষ্য করে।


কর্নেল সমগ্র ৪

ইংরেজিতেই দুজনের কথা চলছিল। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছিল যুবকটি বাঙালি। আজকাল আর আগের মতাে বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের দেখে বাঙালি-অবাঙালি কিছু বােঝা যায় না। তাহলেও এ চোখ কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের। আমি আরও এক পা এগিয়ে তার কাঁধে হাত রাখলুম। সে দ্রুত, যেন, অপ্রত্যাশিত গায়ে-পড়া অন্তরঙ্গতায় খাপ্পা হয়েই ঘুরে দাঁড়াল আমার মুখােমুখি। আমিও দ্রুত বলে উঠলুম, হােয়াট হ্যাপ, ইয়ং ম্যান? কী ঘটেছে? আস্তে কাঁধ থেকে আমার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল, নাথিং!


রবীন্দ্র উপন্যাসঃ ইতিহাসের প্রেক্ষিতে

আমাদের কালের জাতীয় চিন্তকদের প্রধান সমস্যাও হয়েছে আজ তাই। বঙ্কিমের কালের উপন্যাসে শহুরে আদর্শ-সংঘাত বনাম গ্রামীণ জীবন-চিত্রণের বিরােধীদাবির মুখেই “বিষবৃক্ষ”-“কৃষ্ণকান্তের উইল” বনাম “স্বর্ণলতার প্রতিযােগিতা প্রখর হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথই তার মধ্যে সমসাময়িক জীবন-সমস্যার পুরাে চক্রবর্তটিকে একসঙ্গে প্রত্যক্ষ করলেন—মধুসূদনের দুটি লঘুনাটক জুড়ে যে পূর্ণবৃত্তের রূপরেখা প্রথম আভাসিত।রেনেসাঁস-বিচ্ছিন্ন বাঙালি জীবনকে তার পূর্ণায়ত ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে অবধারণের এই অন্তর্দৃষ্টি রবীন্দ্র-উপন্যাসেরই দান বাংলা সাহিত্যে—“করুণা”র অপরিণতির মধ্যেও তার হাতিয়ার-চিহ্নটি পরিস্ফুট।


বুদ্বুদ

“তােমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না। বললাম দুটো টিকিট জোগাড় করে দাও, তাও পারলে না! এমন ভোঁদাই-মার্কা হয়ে থাকলে চলবে?” বিটুদা বিরক্ত হয়ে ‘ভোঁদাই-মার্কা’র সংস্পর্শ এড়াতেই বােধহয় অসম্ভব ভিড়ের মধ্যেও গুতিয়ে জায়গা করে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। আর আমি লজ্জায় লাল হয়ে দেখলাম, আশপাশের মানুষজন ‘ভোঁদাই-মার্কা’-কে মনোেযােগ দিয়ে নিরীক্ষণ করছে। সচরাচর দেখা যায় না তাে, তাই! অফিসের প্রথম দিনেই এ কেমন বেইজ্জতি ভাই! আমি মেট্রোর ভিড়েও যথাসম্ভব অন্যদিকে তাকানাের চেষ্টা করলাম।