প্রকাশিত হলো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ কবিতা সমগ্র্র’র প্রথম খণ্ড , যার মধ্যে গ্রথিত হয়েছে তার ছ’টি কাব্যগ্রন্থ ; ‘একা এবং কয়েকজন’, ‘আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি’, ‘বন্দী , জেগে আছো’, ‘আমার স্বপ্ন’, ‘সত্যবদ্ধ অভিমান’, ও ‘জাগরন হেমবর্ণ’। বাংলা কবিতার যারা প্রেমিক পাঠক , তাদের কাছে এ এক মস্ত খবর সন্দেহ নেই। কেননা ,বাংলা কথাসাহিত্যের সেরা একজন লেখক যিনি, সেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যে বাংলা কবিতারও এক অতিশক্তিমান স্রষ্টা , তা কে না জানে। এই কথাটাও সবাই জানে না যে, পঞ্চাশের শতকে ‘কৃত্তিবাস’ নামক যে আন্দোলন একদিন বাংলা কবিতার মোড় একেবারে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল , সুনীলই ছিল তার নেতৃস্থানীয় কবি। পাঠক , সমালোচক সবাই সেদিন অবাক মেনে নিয়েছিলেন। সবাই লক্ষ্য করেছিলেন যে ,এই কবি কোনও পুরনো কথা শুনাচ্ছেন না। তিনি যা কিছু লিখছেণ তারই ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে এক ঝলক টাটকা বাতাস। আর সেই বাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছে এমন এক সৌরভ, যা তার আগে পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
অবনীন্দ্রনাথ গভর্ণমেণ্ট আর্ট স্কুলের চাকরি ছেড়েছেন, ঝগড়া করেই ছেড়ে দিয়েছেন, প্রায় বছর ছয়েক হল। বাড়িতে বসে দিব্যি ঝাড়া-হাত-পা হয়ে মনের আনন্দে ছবি আঁকছেন, পড়াশুনা করছেন, বেশ আছেন—তিনি কি স্বইচ্ছায় চাকরির ফাঁদে আবার পা গলান ? তাই আশুতােষের প্রতিনিধিরূপে যাঁরাই অবনীন্দ্রনাথের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের সকলকেই তিনি হাঁকিয়ে দিয়েছেন, শ্রীদিনেশচন্দ্র সেনকে সুদ্ধ। এইবার স্বয়ং আশুতােষের পালা ।
সাইকেল রিকশায় উঠতে গিয়ে ফ্যাঁস করে শাড়ি ছিড়ে গেল বিশাখার। বেশ অনেকটা। সঙ্গে সঙ্গে বিশাখার বুকে এমন একটা কষ্টের অনুভব হল, অনেক মূল্যবান কিছু হারালেও ততটা হয় না। প্রত্যেক শাড়িরই দু’রকম আয়ু থাকে, প্রথম হল পছন্দের আয়ু, দ্বিতীয় হল তার টিকে থাকার আয়ু। আচমকা এভাবে ছিড়ে গেলে সেটা যেন অপমৃত্যু। কোনও প্রিয়জনের বিমান দুর্ঘটনার মতন।
একদিকে চন্দন রঙের পদ্ম, আর একদিকে কালীয়নাগের মতাে মেঘনা। চন্দনা পদ্ম | মেঘবতী মেঘনার জলে একটা উচ্ছল গানের কলির মতােই ভেঙে পড়ে। উত্তাল ঢেউয়ে ঢেউয়ে টলমল করে ডিঙি-ডােঙা, শালতি-মাল্লাই, হাজারমণি মহাজনী নৌকো। ব্যাপারীদের ভাউলে আসে উত্তর দিগন্ত থেকে। খেকরি আখ, রসগুড়, সবরী আম, এমনি নানান জিনিসের চালান নিয়ে। যাযাবার পাখির মত পালের পাখনা মেলে অদৃশ্য হয়ে যায় কেরায়া নৌকোর মিছিল, ‘গয়নার নাও’-এর সারি।
গত বছর পুরাে একটি মাস টান টান উত্তেজনার পর হজরতবাল মসজিদে আটক সশস্ত্র কাশ্মীরি জঙ্গিরা আত্মসমর্পণ করল। টিভির পর্দায় সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে আবিদ হােসেন আর গােলাম রসুলের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ওদের প্রসঙ্গ শুরু করার আগে ছােট্ট একটি ভূমিকা আছে। উনিশ শ’ পঁচাত্তর বা ছিয়াত্তরে আমাকে কাশ্মীর যেতে হয়েছিল। বম্বের এক ফিল্ম কোম্পানি বিদেশি গল্প বেমালুম চুরি করে তখন একটা ক্রাইম থ্রিলার জাতীয় ছবি তৈরির ছক পাকা করে ফেলেছে। কাশ্মীরের ব্যাকগ্রাউন্ডে বাংলা-হিন্দি দ্বিভাষিক ছবি। প্রােডিউসারের একটি লোেক, নাম সুরেশ বেরি, কলকাতায় এসে বললে, আমাকে লােকেশানে গিয়ে বাংলা সংলাপগুলাে লিখে দিতে হবে।
ছুটির দিনের এই দুপুরবেলায় রাস্তায় লােকজন খুব কম। গাড়ি টাড়িও বিশেষ চোখে পড়ে না। যা দু-একটা দেখা যাচ্ছে সেগুলাের সারা গায়ে আলস্য মাখানাে। যেন কোথাও যাবার তাড়া নেই তাদের; গড়িমসি করতে করতে এগিয়ে চলেছে। নভেম্বর মাস শেষ হয়ে এল। কলকাতা মেট্রোপলিসের ওপর দিয়ে কনকনে উত্তুরে হাওয়া ঘােড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে। আকাশ একেবারে পরিষ্কার ; কোথাও মেঘের চিহ্ন নেই। সূর্য সরাসরি মাথার ওপরে উঠে এসেছে। শীতের ঠাণ্ডা সােনালি আলােয় ঝলমল করছে চারিদিক।
ছড়ানাে কমপাউন্ডের মধ্যিখানে বিশাল তেতলা বাড়িটার আগাপাশতলা সেকেলে অর্কিটেকচারের ছাপ। পুরু পুরু ছত্রিশ ইঞ্চি দেওয়াল। সেগুন কাঠের চওড়া চওড়া, মজবুত দরজা। জানালায় দু’টো করে পাল্লা। সেগুলাের একটায় খড়খড়ি, অন্যটায় রঙিন কাচ বসানাে। উঁচু উঁচু সিলিংয়ে পঙ্খের কাজ। বাড়িটার সামনে এবং পেছনের ফাঁকা জায়গায় একসময় খুব যত্ন করে বাগান করা হয়েছিল। দামি দামি, দুর্লভ গাছ কবেই হেজেমজে গেছে।
এমন আকাশ হবে তােমার চোখের মতাে ভাষাহীন নির্বাক পাথর, দৃষ্টি তার স্থির হবে মৃতের প্রাণের মতাে উদাসীন নির্মম শীতল, তুমি আছাে সর্বময় রাত্রির গহনে মিশে –আমি এক ক্লান্তির কফিনে, তুমি যদি মৃত্যু আনাে অবসাদে মূক আর কঠিন কুটিল রাত্রি জুড়ে হে আমার তমস্বিনী মর্মরিত রাত্ৰিময় মালা, মৃত্যুফুলে বেদনার প্রাণদাহী ফুলে ফুলে হে আমার উদাসীন মালা, আমার জীবন তুমি জর্জরিত করাে এই দিনে রাত্রে দুপুরে বিকেলে এবং আমাকে বলাে,
ঘূর্ণিত পতন আছে আশেপাশে যােজন-গভীরে,
অসম্ভব অভিপ্রায় দোলায় শিকড়-ফাটা মাটি,
দ্বিখণ্ডিত রশ্মি হায় নিরুদ্দিষ্ট দিগন্ত-সমীরে।
বঞ্চিত সে-দ্বিপ্রহর পুড়ে পুড়ে হয়েছে কি খাঁটি?
দীর্ঘশ্বাসে তীক্ষ্ণ ধার, কলঙ্ক পড়েছে সাদা চাদে ;
ঊর্ধ্বরেখা হ্রস্বতর, হ্রস্বতর মনের কথাটি।
রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র ও বহুমুখী কীর্তির মধ্যে তার একটি পরিচয় যেন একটু চাপা পড়ে গেছে বলে মনে হয়। সেটি হল তার সমালােচনা। এটা খুবই বিস্ময়কর এইজন্য যে তার সমালােচনাত্মক রচনা তার সাহিত্যরচনাবলীর একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। “সাহিত্যের পথের ভূমিকায় কবি নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছেন, রসসাহিত্যের রহস্য নিয়ে অনেক কাল থেকেই আগ্রহের সঙ্গে আলােচনা করে আসছি। এই ‘অনেক কালটা’ কত কাল, সনতারিখ একটু মিলিয়ে দেখলেই দেখা যাবে সেটা প্রায় সারাজীবন, অন্তত সাহিত্যজীবন তাে বটেই।