ছােট্ট বাংলাে-বাড়িটার কাঠের রেলিং ঘেরা বারান্দায় বসে আছে ওরা। ভুটান রাজ্যের প্রাক্তন রাজধানী পুনাখায়। বাড়িটা পাহাড়ের ঢালে, গঞ্জের কোলাহল ছাড়িয়ে। অথচ গুম্ফাটা স্পষ্ট দেখা যায় এই বারান্দায় বসলে। আর দেখা যায় বালিপাথরে বুকভরা মাে চু আর পাে চু নদী দু’টোকে। যারা এসে মিলিত হয়েছে গুম্ফাটার গায়ের ঠিক পাশটিতে।
গণপতি তাঁর হস্তিমুণ্ডটি ঈষৎ আন্দোলিত করে বললেন, “ঋষিবর! এই মহাগ্রন্থের অবতরণিকা অংশে আপনি বলেছিলেন, ধর্মে চার্থে কামে চ মােক্ষে চ, অর্থাৎ ধর্মঅর্থকামমােক্ষ— এই চতুর্বর্গ সম্বন্ধে যাবতীয় তত্ত্বের আকর হবে এই মহাভারত। কিন্তু এখনও অবধি যতগুলি শ্লোক আপনি রচনা করেছেন এবং আমি অনুলিখন করেছি, তার মধ্যে সেই মহৎ অভিপ্রায় তাে পরিস্ফুট হল না।” মহাকবি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন মৃদু হাস্যকরলেন। তারপর ঈষৎ কৌতুকজড়িত কণ্ঠে বললেন, “দেব লম্বােদর, আপনার উদর যতটা বিপুল, ধৈর্য তত পরিমাণেই অপ্রতুল দেখি! এ যে সবে আদিপর্ব! গ্রন্থ অনুলিখনের প্রাক্কালেই তাে বলে দিয়েছিলাম, অষ্টাদশ পর্ব অবধি বিস্তৃত হবে এ কাহিনি।”
গােলােকে আজ মহা গােলযােগ। বসুন্ধরাকে নিয়ে দেবতারা সব আসছেন। তাঁরা এই মুহূর্তে রয়েছেন ব্রহ্মার দরবারে। পৃথিবীতে পাপ বেড়েছে। দৈত্যকুল সব ছারখার করে দিচ্ছে। এখন সেখানে বরাহকল্প। অসুরদের উৎপাতে সেখানে আর টেকা যাচ্ছে না। দেবতারা চিরকালই দুর্বল। তারা ধরিত্রীমাতাকে নিয়ে ব্রহ্মসভায় ব্রহ্মার কাছে এসেছেন। দুর্গম পথ পেরিয়ে তারা এসেছেন। ক্লান্ত, শ্রান্ত, উদ্বিগ্ন। একমাত্র স্রষ্টাই পারবেন সৃষ্টির বিনাশ ঠেকাতে। কেন তিনি অসুর সৃষ্টি করলেন— এ প্রশ্ন অবান্তর। কোনও কিছু সৃষ্টি করতে গেলেই অনাসৃষ্টি অবশ্যম্ভাবী। যেমন চিনির রস জ্বাল দিলেই গাদা বেরােবে। ঘি জ্বাল দিলেই খানিকটা ছাঁচ। ও হবেই।
আলাে অন্ধকারে মেশানাে একটা সকাল আজ। ভেজা হাওয়ায় কেমন যেন মন খারাপ করা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। চোয়াল শক্ত করে দৌড়ােনাে এই শহরের চোখেও আজ যেন আনমনাভাব। একলা চড়াই হয়ে সকলে যেন বসে আছে নির্জন বারান্দায় আর আমায় বলছে, ও নেই! বলছে, এ জীবনের মতাে ও চলে গিয়েছে আমায় ছেড়ে। আমি ওড়না দিয়ে মুখটা মুছলাম। মেঘ করে থাকায় সারা কলকাতা জুড়ে আজ কেমন একটা কম্বলচাপা গরম। ছােট গলিটা থেকে বড় রাস্তায় বেরিয়ে দাঁড়ালাম একটু। মনখারাপের মাঝেও হঠাৎ হাসি পেল! কোন দিন ও আমার ছিল? জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তাে ওকে দেখছি! কিন্তু তাও কোনও দিনও কি আমার ছিল ও?