গাড়ির চাকা এতক্ষণে গড়াল। নীপার মনে হল, স্টার্ট দিয়ে থেমে বীতশােক কী যেন ভাবছিল। গাড়িটা পুরনাে মডেলের অ্যাম্বাসাডর। কিন্তু পৌরাণিক বীরদের মতাে স্থিতধী এবং দার্শনিকও। নীপার এইরকম মনে হয়। সে সােমনাথের আঁতলামিকে ব্যঙ্গ করে। অথচ কোনও-কোনও সময়ে সে নিজের চিন্তায় আঁতলামি লক্ষ্য করে।
ইংরেজিতেই দুজনের কথা চলছিল। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছিল যুবকটি বাঙালি। আজকাল আর আগের মতাে বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের দেখে বাঙালি-অবাঙালি কিছু বােঝা যায় না। তাহলেও এ চোখ কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের। আমি আরও এক পা এগিয়ে তার কাঁধে হাত রাখলুম। সে দ্রুত, যেন, অপ্রত্যাশিত গায়ে-পড়া অন্তরঙ্গতায় খাপ্পা হয়েই ঘুরে দাঁড়াল আমার মুখােমুখি। আমিও দ্রুত বলে উঠলুম, হােয়াট হ্যাপ, ইয়ং ম্যান? কী ঘটেছে? আস্তে কাঁধ থেকে আমার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল, নাথিং!
আমাদের কালের জাতীয় চিন্তকদের প্রধান সমস্যাও হয়েছে আজ তাই। বঙ্কিমের কালের উপন্যাসে শহুরে আদর্শ-সংঘাত বনাম গ্রামীণ জীবন-চিত্রণের বিরােধীদাবির মুখেই “বিষবৃক্ষ”-“কৃষ্ণকান্তের উইল” বনাম “স্বর্ণলতার প্রতিযােগিতা প্রখর হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথই তার মধ্যে সমসাময়িক জীবন-সমস্যার পুরাে চক্রবর্তটিকে একসঙ্গে প্রত্যক্ষ করলেন—মধুসূদনের দুটি লঘুনাটক জুড়ে যে পূর্ণবৃত্তের রূপরেখা প্রথম আভাসিত।রেনেসাঁস-বিচ্ছিন্ন বাঙালি জীবনকে তার পূর্ণায়ত ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে অবধারণের এই অন্তর্দৃষ্টি রবীন্দ্র-উপন্যাসেরই দান বাংলা সাহিত্যে—“করুণা”র অপরিণতির মধ্যেও তার হাতিয়ার-চিহ্নটি পরিস্ফুট।
“তােমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না। বললাম দুটো টিকিট জোগাড় করে দাও, তাও পারলে না! এমন ভোঁদাই-মার্কা হয়ে থাকলে চলবে?” বিটুদা বিরক্ত হয়ে ‘ভোঁদাই-মার্কা’র সংস্পর্শ এড়াতেই বােধহয় অসম্ভব ভিড়ের মধ্যেও গুতিয়ে জায়গা করে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। আর আমি লজ্জায় লাল হয়ে দেখলাম, আশপাশের মানুষজন ‘ভোঁদাই-মার্কা’-কে মনোেযােগ দিয়ে নিরীক্ষণ করছে। সচরাচর দেখা যায় না তাে, তাই! অফিসের প্রথম দিনেই এ কেমন বেইজ্জতি ভাই! আমি মেট্রোর ভিড়েও যথাসম্ভব অন্যদিকে তাকানাের চেষ্টা করলাম।
উড়তে উড়তে বাজপাখি যেমন তার বত্তকে ক্রমশ ছােট করে আনে, তারপর লাফিয়ে। পড়ে শিকারের ওপর তেমনি অভিরাম বহ, পরিশ্রম আর পর্যবেক্ষণের ফল হিসেবে যখন শিকারকে হাতের মুঠোয় পায়, তখন তার মনে নিঠুরতা নেই, হিংসা নেই, ক্রোধ নেই আছে শুধু পরিষ্কারভাবে কাজ শেষ করার চমৎকার আনন্দ। প্রতিটি হত্যার পর। তার মনে আশ্চর্য প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে। কাজ শেষ হতে দেরি হলে, কিম্বা বাধা পড়লে। ভয়ানক বিরক্তি জন্মায়। জীবনের দ্বিতীয় কি তৃতীয় কাজের কথা এখনাে মনে পড়ে।