আরেক বার তিন জনে ছাদ-ফাটানাে হাসি হেসে দাবা খেলতে বসলেন। অর্থাৎ ভাষাবিদ ও দার্শনিক বসলেন, নাট্যকার দাঁড়িয়ে চুরুট ধরিয়ে অযাচিত মাতব্বরি করতে উদ্যত হলেন। কালীকান্ত অপমান বােধ করলেন, কিন্তু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারলেন না, কারণ একটু পরে চা-স্যান্ডুই আসবে। তাই ঝগড়ায় মাতবেন স্থির করে চেঁচিয়ে বললেন—কোথায় ভুল? - এ লেখার কোথায় ভুল দেখান দিকি ?
পাড়াটায় ছ-সাত ঘর ব্রাত্মণের বাস মােটে। সকলের অবস্থাই খারাপ। পরস্পরকে ঠকিয়ে পরস্পরের কাছে ধার-ধাের করে এরা দিন গুজরান করে। অবিশ্যি কেউ কাউকে খুব ঠকাতে পারে না, কারণ সবাই বেশ হুঁশিয়ার। গরিব বলেই এরা বেশি কুচুটে ও হিংসুক, কেউ কারও ভাল দেখতে পারে না, বা কেউ কাউকে বিশ্বাসও করে না।
যাত্রার আগে কয়েকটি তথ্য আমরা সংগ্রহ করে নিয়েছিলাম। বরপেটা রােডের বাজারে রাত্রির আহার সেরে পরের দিনের খাদ্য সংগ্রহ করে নিতে হবে। কেন না, তারপর মাইল পঁচিশেকের মধ্যে আর কোনও দোকান নেই। চেক পোেস্ট থেকে প্রায় মাইল পনেরাে দূরে ঘন অরণ্যের মধ্যে ডাক বাংলােতে খাদ্য ব্যবস্থা রাখা সম্ভব হয় না। তবে বাংলােতে আমার নামে একটা ঘর আগে থেকেই রিজার্ভ করা আছে, সে জন্য চৌকিদার আমাকে ফেরাবে না, এবং আমি সঙ্গে চাল ডাল নিয়ে গেলে সে রান্না করে দেবে। মানস অরণ্যে দর্শনাথী অধিকাংশই সাহেব হয়, তারা সঙ্গে টিনের কৌটোয় খাদ্য ও পাঁউরুটি নিয়ে যায়। ডাকবাংলােয় আলাে নেই, আমাদের মােমবাতিও নিতে হবে সঙ্গে করে। বরপেটা রােড বাজার পৌঁছবার আগেই নিকষ কালাে রাস্তায় জিপ গাড়িটা দুবার হেঁচকি তুলে থেমে গেল। আমি সচকিতে ওঝাকে জিগ্যেস করলাম, কী হল?
হইলেন। তিনি বলিলেন, কি এক দুর্গন্ধ, অনুভব করিতেছেন। উহা নিবারণের জন্যে নাসিকা আচ্ছাদিত করিয়াছেন। তখন নবাব বলিলেন, তবে তিনি জাতিভ্রষ্ট হইয়াছেন; কারণ, “ঘ্রাণ অর্ধেক ভােজন।” শ্যাম রায় আপন অস্ত্রে আপনি আহত হইয়া, তাহা স্বীকার করিলেন। সে দিন হইতে তিনি জাতিভ্রষ্ট হইলেন। তাঁহার বংশীয়েরা চট্টগ্রামের মুসলমান-সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনও অগ্রগণ্য। ইহারা মুসলমান হইলেও আমরা ইহাদিগকে কুটুম্বের মত শ্রদ্ধা ভক্তি করি।
যে বিস্তৃত বনভূমি উত্তর আমেরিকা ও ক্যানাডার উপর ছড়িয়ে পড়েছে, তার উপর রাজত্ব করছে দুরন্ত শীত। দারুণ ঠান্ডায় নদীর জল জমে বরফ হয়ে গেছে। তরল জলধারার পরিবর্তে দেখা দিয়েছে নিরেট বরফ-ঢাকা পথ। অস্পষ্ট আলাে-আঁধারিতে প্রেতপুরীর প্রহরীর মতাে বরফ-ঢাকা পথের দুই ধারে দাঁড়িয়ে আছে কালাে কালাে গাছের সারি। চারদিকে শুধু বরফ, বরফ আর বরফ। বিশাল বনভূমি এখন তুষারে আচ্ছন্ন মৃত্যুপুরীর মতােই নিস্তব্ধ ভয়ংকর, কোথাও নেই প্রাণের সাড়া.........