বয়স নেহাত কম নয় মহিলার। অন্তত বছর পঁয়তাল্লিশ তাে হবেই। মুখেও ভাঙচুর এসেছে টুকটাক। তবু সাজগােজের কী বহর! চোখে গাঢ় আই-লাইনার, ঠোটে চড়া লিপস্টিক, গালে থুতনিতে ব্লাশ-অনের উৎকট ছােপ। কাঁধ ছোঁওয়া স্টেপ-কাট চুলে সরু সরু সােনালি টান। দামি শিফন শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজটিও বিপজ্জনক রকমের সংক্ষিপ্ত। বােঝাই যায় খুকি সাজার চেষ্টায় মহিলার কোনও খামতি নেই।
প্রাচীন ও আধুনিক কবিতার প্রস্থানভূমির পার্থক্য যদি এক কথায় বলতে হয়, এটুকু বললেই পর্যাপ্ত হবে, প্রাচীন কাব্যের মূলসূত্র রচয়িতার আত্মবিলুপ্তি এবং পরবর্তী কবিতার উপপাদ্য অভিমানী অহং। এই প্রভেদ সত্ত্বেও বাংলা কবিতায় আধুনিকতার চরিত্র ও মাত্রা সংক্রান্ত আলােচনায় মধুসূদন-পূর্ব অধ্যায়ের প্রবেশাধিকার অস্বাভাবিক নয়।
সেকালে হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলের হেডমাস্টারবাবু বিদ্যালয়ের রত্ন বলিয়া যে তিনটি ছেলেকে নির্দেশ করিতেন, তাহারা তিনখানি বিভিন্ন গ্রাম হইতে প্রত্যহ এক ক্রোশ পথ হাঁটিয়া পড়িতে আসিত। তিনজনের কি ভালবাসাই ছিল! এমন দিন ছিলনা, যেদিন এই তিনটি বন্ধুতে স্কুলের পথে ন্যাড়া বটতলায় একত্র না হইয়া বিদ্যালয়ে প্রবেশ করিত! তিন জনেরই বাড়ি ছিল হুগলির পশ্চিমে। জগদীশ আসিত সরস্বতীর পুল পার হইয়া দিঘড়া গ্রাম হইতে, এবং বনমালী ও রাসবিহারী আসিত দুইখানি পাশাপাশি গ্রামকৃষ্ণপুর ও রাধাপুর হইতে। জগদীশ যেমন ছিল সবচেয়ে মেধাবী, তাহার অবস্থাও ছিল সবচেয়ে মন্দ। পিতা একজন ব্রাহ্মণপণ্ডিত। যজমানি করিয়া, বিয়া-পৈতা দিয়াই সংসার চালাইতেন। বনমালীরা সঙ্গতিপন্ন জমিদার। তাহার পিতাকে লােকে বিত্তশালী ব্যক্তি বলিয়াই জানিত, অথচ পল্লীগ্রামের সরল জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতেন। রাসবিহারীদের অবস্থাও বেশ সচ্ছল। জমিজমা চাষবাস পুকুরবাগান, পাড়াগাঁয়ে যাহা থাকিলে সংসার চলিয়া যায়—সবই ছিল।
এই পাণ্ডববর্জিত স্টেশনেও গােটা তিরিশেক লােক নেমেছে, তার মধ্যে ঠিক আমাদের কী করে চিনতে পারল কে জানে। হয়তাে আর সবাই স্থানীয় লােক, তাদের অন্ধকারেও চেনা যায়। কিংবা আমাদের মুখ কিংবা দাঁড়াবার ভঙ্গিতে কলকাতার নাম লেখা আছে। সুবিমল কিছুতেই অবাক হয় না সহজে, সপ্রতিভভাবে বলল, চল সুনীল। লােক দুটিকে জিজ্ঞেস করল, গাড়ি আছে তাে?
ইংল্যাণ্ডের নেতারা ইচ্ছা প্রকাশ করলেন জর্মানী, ইতালির ফ্রান্সের ঘরের খবরাখবর চাই। ইনটেলিজেন্স সাভিসকে পুনগঠন করবার দাবী উঠল। যারা এই দাবী করেছিলেন তারা ছিলেন ধনী, জমিদার এবং রাজনীতিতে রক্ষণশীল। এরা দেশের অর্থনীতি তৈরি করতেন এবং এরা রাশিয়ার বিরােধী ছিলেন এবং কমনিজম এদের কাছে জুড়ি ছিল। এদের মধ্যে অনেকে হিটলারের গােপন সমর্থকও ছিলেন। একটি উদাহরণ হল সম্রাট পঞ্চম জজের বড় ছেলে প্রিন্স অব ওয়েলস, যিনি পরে ডিউক অব উইণ্ডসর নামে ইতিহাসে পরিচিত হয়ে ছিলেন, তিনি ছিলেন হিটলারের গােপন সমর্থক।
গা-ছমছমে ভয়ংকর বাঘের গল্প শুনতে কে-না ভালোবাসে! বনের রাজা বাঘ না হলেও, বাঘের চেহারা ও হাঁটা-চলার মধ্যে আছে আশ্চর্য রাজকীয় ব্যাপার। ‘বাঘ’ শব্দটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক শিহরণ জাগানো রোমাঞ্চ। সুন্দর রায়ের পুরুত ঠাকুরের মশাল হাতে বাঘের দিকে তেড়ে যাওয়া, কলমের কেরামতিতে সাপ-ব্যাং দিয়ে মজাদার বাঘ-শিকার, যোশিপুরের ফরেস্ট অফিসার সরোজবাবুর খৈরি নদীর ধার থেকে কুড়িয়ে আনা বাঘের বাচ্চা, ঋজুদার বন্দুকে লাওয়ালঙের বাঘ শিকার, বিধু দারোগার সেই বদন গাছে বেঁধে রাখা লাজুক বাঘের গল্পে ঠাসা এই বই। শিবরাম চক্রবর্তী, লীলা মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, শৈলেন ঘোষ, অতীন বন্দোপাধ্যায়, নির্বেদ রায়, এরকম পঁচিশজন লেখকের কলমে রোমাঞ্চকর পঁচিশটি মনকাড়া বাঘের গল্পের এই সংকলন। জঙ্গলের বাঘ জঙ্গলে থাকুক, অভয়ারণ্যের বাঘ থাকুক অভয়ারণ্যে। আমরা দুই মালাটের মধ্যে বন্দি পঁচিশটি বাঘের গল্প তুলে দিলাম মরমি পাঠকের হাতে।
টুই জানলা দিয়ে উল্টোদিকে চেয়েছিল। মুখ না ঘুরিয়েই বলল, সব পুরুষই তাই। সাে হােয়াট্! তাদের ছাড়া চলেও না যে মেয়েদের! তােমার মত এত স্বাবলম্বী ওয়েল-অফ মেয়েরও চলেনা কি? তুমি কিন্তু যাই-ই বলাে টিটিদিদি, আমি জানি না, কেন আমার এখনও খুব ভালাে লাগে অমুদাকে। ভেরি নাইস গাই! ভেরি আন্ডারস্ট্যান্ডিং, লাভিং। খুবই নরম মানুষ। আ জেনুইন পার্সন। মেকী মানুষে ভরে গেছে এই পৃথিবী। আমি জানি না, তােমার মত হাইলি ইন্টেলিজেন্ট মানুষ হয়ে তুমি এমন ভুল করলে কি করে?
দিনের বেলায়ও রাতের অন্ধকার নেমে রয়েছে জায়গাটায়। বাইরে থেকে বুঝতে পারা যায় নি অত। অন্য গাঁয়ের ভিতর দিয়ে এখানে আব্বার সময় অনেকেই গাড়োয়াল হিমালয়ের এই সিনচুরি বনভূমির অনেক কথাই শনিয়েছে। এটা রাক্ষসে অরণ্য। এখানকার রডােডেনড্রন পাইন আর চীৱ গাছগুলাে একেবারে মানুষখেকো দানবদের বংশধর। গাছ সেজে ঘন জঙ্গলের ফাঁদ পেতে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে সব। এখনাে কত নরকঙ্কাল এখানে ওখানে পড়ে রয়েছে ভিতরে।
সিমি মানে সীমন্তিনী বড়ুয়া। আমাদের সঙ্গেই গ্র্যাজুয়েশান করেছে। মেয়েটা। তারপর আমাদের সঙ্গেই ভরতি হয়েছে এম এতে। ইলেশের ওকে। খুব পছন্দ! খুব মানে ‘খ’-এর পরে অনেক হ্রস্ব-উ দিয়ে খুব। সেই কলেজের ফার্স্ট ইয়ার থেকে সিমির পিছনে লাইন দিয়েছে ইলেশ। সেই কারণেই ওর নিজেদের ব্যাবসায় না ঢুকে ইউনিভার্সিটিতে ঢােকা। কিন্তু আজও খুব একটা সুবিধে করতে পারেনি ও! সিমি ওকে পাত্তাই দেয় না!
আগেকার দিনের কর্তাদের বেশ একটা ভারিক্কি চাল ছিল । দেখলেই বােঝা যেত, ইনি কর্তাব্যক্তি মানুষ, স্ত্রীপুত্র পরিবার নিয়ে সংসার করেন। একমেবা দ্বিতীয়মের সন্ধান পেয়ে গেছেন । উড়ু উড়ু, প্রেমিক-প্রেমিক ভাব আর নেই । যা পেয়েছি প্রথম দিনে, তাই যেন পাই শেষে । যার মুখ দেখে এতকাল ঘুম ভাঙছে, সেই মুখটিই যেন খাবি খাবার সময় ঝাপসা ঝুলে থাকে, মৃত্যুপথযাত্রীর চোখে । 'চললুম ডার্লিং, হুলাে রইল, রােজগার করে খাওয়াবে । একটি ভাল ছেলে দেখে বুচীটার বিয়ে দিও। আহা সমুখে শান্তির পারাবার ।
‘প্রাকৃত’ শব্দের অনেক অর্থ আছে অভিধানে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে ‘লৌকিক’। সচরাচর আমাদের ইন্দ্রিয় আমাদের যা দেখায়, শোনায়, উপলব্ধি করায়, তা-ই লৌকিক। লৌকিক শব্দেরও অভিধানে অনেক অর্থ; তার মধ্যে আছে জাগতিক, সাংসারিক, সামাজিক। এখন যা সচরাচর সমাজে, সংসারে বা এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে আমরা দেখতে পাই না, অথচ তার অস্তিত্ব আছে বলে ধারণা করা হয়, তাই লৌকিক নয়, অলৌকিক। অন্যভাবে বলতে গেলে অপ্রাকৃত।
এখানে কোনও বাণী নেই, মাথায় ঢিসুম কোনও কারুকাজ নেই, কোনও গ্রাম্ভারি বক্তব্য নেই, কোনও তথাকথিত সুতোও নেই - যা ধরে পাঠক ঝুলবেন। এখানে কিছু আঁকিবুঁকি আছে, ক্ষতদাগ আছে, গল্পবীজ আছে - তবে ক্ষত খুঁটে গল্প তোলার তাগিদও নেই কোনও। শুধু রাস্তার বাঁকে বাঁকে চলে যাচ্ছে আমাদের চারিপাশ, আমাদের সময়, আমাদের বাঁচা। খানিকটা রোজনামচার ঢঙে, খানিকটা স্বগতোক্তির মতো। নিজের সঙ্গে বকবক কিম্বা হঠাৎই এক উন্মাদের ছটফটিয়ে ওঠা, চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দিতে চাওয়া, ঘেঁটে দিতে চাওয়া এই প্রকাণ্ড সুস্থতাকে।