তার ব্যবহারও বাংলা উপন্যাসে প্রথম। অবচেতন, প্রতীক ও সংলাপকে তিনি চরিত্রের নিঃশর্ত স্বাধীন বিবর্তন ঘটাতে ব্যবহার করেছেন। দিন ও রাত্রির, স্থল ও জলের মােহনায় চরিত্রের জন্মান্তর সাধিত হয়েছে। ইন্দ্রিয়-নির্ভর জগৎ থেকে অবচেতনের অনুভূতিতে শচীশের বারবার প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। শুধু তাই নয়, নির্বিশেষকে সে বিশেষরূপে পেতে চেয়েছে, বিশেষকে অতিক্রম করেই নির্বিশেষে যেতে চেয়েছে। শচীশের উক্তিই তার প্রমাণ।
ঘূর্ণিত পতন আছে আশেপাশে যােজন-গভীরে,
অসম্ভব অভিপ্রায় দোলায় শিকড়-ফাটা মাটি,
দ্বিখণ্ডিত রশ্মি হায় নিরুদ্দিষ্ট দিগন্ত-সমীরে।
বঞ্চিত সে-দ্বিপ্রহর পুড়ে পুড়ে হয়েছে কি খাঁটি?
দীর্ঘশ্বাসে তীক্ষ্ণ ধার, কলঙ্ক পড়েছে সাদা চাদে ;
ঊর্ধ্বরেখা হ্রস্বতর, হ্রস্বতর মনের কথাটি।
রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র ও বহুমুখী কীর্তির মধ্যে তার একটি পরিচয় যেন একটু চাপা পড়ে গেছে বলে মনে হয়। সেটি হল তার সমালােচনা। এটা খুবই বিস্ময়কর এইজন্য যে তার সমালােচনাত্মক রচনা তার সাহিত্যরচনাবলীর একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। “সাহিত্যের পথের ভূমিকায় কবি নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছেন, রসসাহিত্যের রহস্য নিয়ে অনেক কাল থেকেই আগ্রহের সঙ্গে আলােচনা করে আসছি। এই ‘অনেক কালটা’ কত কাল, সনতারিখ একটু মিলিয়ে দেখলেই দেখা যাবে সেটা প্রায় সারাজীবন, অন্তত সাহিত্যজীবন তাে বটেই।
একক বিচ্ছিন্ন মানুষের ভাষা নেই। একে অন্যের সঙ্গে যখন কথা বলে— সেই কথা বলাই ভাষা হয়ে ওঠে। চারপাশের লােকজনের মধ্যে যে শিশু বেড়ে ওঠে সে অনায়াসেই শিখে যায় সেই ভাষা। কথা বলা, শুনে বুঝতে পারা, নিজে বলতে পারা এই সবই ভাষা শেখার নানা নিদর্শন। ব্যাকরণ পড়ে বুঝতে হয় না। ভাষার ব্যাকরণ কথা বলার মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। সেই ব্যাকরণ ভাষা ব্যবহার করছে এমন মানুষজনদের ধারণার মধ্যে থেকে যায়। মাথার মধ্যে ধারণা হিসেবে থাকা ভাষার সেই নিয়মকানুনই হল কোনাে একটি ভাষার ব্যাকরণ।
দায়রা জজ ফাঁসির হুকুম দিলে আসামি শফিউজ্জামানের একজন কালাে আর একজন শাদা মানুষকে মনে পড়ে গিয়েছিল। এদেশের গ্রামাঞ্চলে শিশুরা চারদিকে অসংখ্য কালাে মানুষ দেখতে-দেখতে বড় হয় এবং নিজেরাও কালাে হতে থাকে। কিন্তু শাদা মানুষ, যার নােম ভুরু ও চুলও প্রচণ্ড শাদা, ভীষণ চমকে দেয়। . এর আগে শফিউজ্জামান ‘বিপজ্জনক ব্যক্তি’ ঘােষিত হন। একবার তাকে সাত বছরের জন্য জেলা থেকে নির্বাসিত করা হয়। ইংরেজের আইন একেক সময়ে ভারি অদ্ভুত, চেহারা নিত।
“আমাদের নােয়াখালিবাসের শেষ পর্যায়ে আমার সময়টা তেমন ভালাে লাগেনি। আমি আত্মসচেতন হয়ে উঠছি, নিজের অনেক প্রকৃতিদত্ত ক্রটি আবিষ্কার করে ক্ষুন্ন হয়ে আছি। সমবয়সী অন্য ছেলেদের তুলনায় আমি বেঁটে, আমি রােগা এবং দুর্বল-ফুটবল দূরে থাক, ব্যাডমিন্টনেও আমার অল্পেই দম ফুরিয়ে যায়...কিন্তু প্রায় একই সময়ে, আমি এ-ও বুঝেছি যে আমার হাতে এসব বঞ্চনার একটি উত্তর এসে গিয়েছে-একটি ক্ষতিপূরণের উপায়, হয়তাে বা এমন কোনাে ক্ষমতা যা সকলের থাকে না।
মােম্বাসা থেকে নাইরােবি যেতে হলে উগান্ডা রেলপথ ধরেই যেতে হবে। পৃথিবীতে এত সুন্দর রেলপথ সম্ভবত দ্বিতীয় আর নেই। আর সেই রেলযাত্রা ব্রিটিশ ইস্ট আফ্রিকাতে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক অভিজ্ঞতা বললেও কিছু অত্যুক্তি হবে না। সাগর থেকে যাত্রা করে সুবিস্তৃত ভূখণ্ড পেরিয়ে এই রেলপথ গিয়ে শেষ হয়েছে ভিক্টোরিয়া নিয়ানঞ্জাতে। শুরুতে শহর মােম্বাসা; তিনশাে তিরিশ মাইল দূরের শেষ শহর হল নাইরােণি। মাঝে মাঝে ঢেউ খেলানাে টিনের ঘর ঘিরে কয়েকটা কুটির। এইগুলােই হল রেল থামবার স্টেশন। ভবিষ্যতে যেগুলাের বিরাট বড় বড় শহর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আমার দৌড় অনেককাল অবধি বাংলা বিহার ওড়িশার সীমা ডিঙোয়নি। উনিশ শশা পঁচাত্তরে প্রথম দিল্লি যাওয়ায় সে কী উত্তেজনা। দিল্লি! আমি তা হলে দিল্লি যাচ্ছি! আঁ! তারপরে অবশ্য নানা কাজে অকাজে ভারতবর্ষের এক প্রান্ত থেকে আর একপ্রান্ত অবধি টানা মারতে হয়েছে। তবু অদেখা রয়ে গেছে কত রাজ্য। আমার তাতে দুঃখ নেই। যাকে ভ্রমণবিলাসী বলে আমি তেমন নই। গেলেও হয় না গেলেও চলে যায়। বরং বাংলার গ্রাম-প্রান্তরে ছােটো ছােটো স্বল্পক্ষণের ট্রিপ আমার ঢের বেশি প্রিয়।
তিনি বলেছেন, “আমি বাঙালি জাতির বিদূষক মাত্র। তবে রসিকতাচ্ছলে সত্য কথা বলতে গিয়ে ভুল করেছি। কারণ নিত্য আমি দেখতে পাই যে, অনেকে আমার সত্য কথাকে রসিকতা বলে, আর আমার রসিকতাকে সত্য কথা বলে ভুল করেন। এখন এ ভুল শােধরাবার আর উপায় নেই। পাঠকেরা যে আমার লেখার ভিতর সত্য না, পান, রস পেয়েছেন, এতেই আমি কৃতার্থ।” (তদেব)। এই তীক্ষ ব্যঙ্গদিগ্ধ মন্তব্যের আলােয় প্রমথ চৌধুরীর মনের চেহারাটা আমাদের কাছে স্পষ্ট প্রতিভাত হয়। বাংলা সাহিত্যে ও বাঙালি জীবনে ইমােশ-এর অতিচর্চার ফলে মননশীলতার হানি হয়েছে এবং সেজন্য আমাদের জীবনে ও সাহিত্যে জ্ঞানের ফসল ফলেনি। এই কারণে আমাদের মানসিক অধঃপতন ঘটেছে।