এই কাহিনীর ঐতিহাসিক পটভূমিকা Robert Sewell-এর A Forgotten Empire এবং কয়েকটি সমসাময়িক পান্থলিপি হইতে সংগৃহীত| Sewell-এর গ্ৰন্থখানি ৬৫ বছরের পুরাতন। তাই ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয়ের সম্পাদিত সাম্প্রতিক গ্ৰন্থ The Delhi Sultanate পাঠ করিয়া Sewell-এর তথ্যগুলি শোধন করিয়া লইয়াছি। আমার কাহিনীতে ঐতিহাসিক চরিত্র থাকিলেও কাহিনী মৌলিক; ঘটনাকাল খৃ ১৪৩০-এর আশেপাশে। তখনো বিজয়নগর রাজ্যের অবসান হইতে শতবর্ষ বাকি ছিল।
অনেকের ধারণা পোর্তুগীজদের ভারতে আগমনের (খৃ ১৪৯৮) পূর্বে ভারতবর্ষে আগ্নেয়াস্ত্রের প্রচলন ছিল না। ইহা ভ্ৰান্ত ধারণা। ঐতিহাসিকেরা কেহ কেহ অনুমান করেন, সুলতান ইলতুৎমিসের সময় ভারতবর্ষে আগ্নেয়ন্ত্রের ব্যবহার ছিল। পরবর্তীকালে স্বয়ং বাবর শাহ তাঁহার আত্মজীবনীতে লিখিয়া গিয়াছেন যে, বাঙ্গালী যোদ্ধারা আগ্নেয়াস্ত্ৰ চালনায় নিপুণ ছিল। এই কাহিনীতে আগ্নেয়াস্ত্রের অবতারণা অলীক কল্পনা নয়। তবে বাবর শাহের আমলেও ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্ৰ ভারতে আবির্ভূত হয় নাই।
দেশ-মান সম্বন্ধে সেকালে নানা মুনির নানা মত দেখা যায়। চাণক্য এক কথা বলেন, অমরসিংহ অন্য কথা। আমি মোটামুটি ৬ ফুটে ১ দণ্ড, ২০ গজে ১ রাজু এবং ২ মাইলে ১ ক্রোশ ধরিয়াছি।
গৌতম বুদ্ধের জীবৎকাল তথা ভারত-ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়কে অবিকল ও প্রাণবন্ত চেহারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন বিদগ্ধ কথাকার বাণী বসু, দু-পর্বে সুবিন্যাস্ত তার এই বিশাল, বেগবান,বর্ণময় উপন্যাসে। এই কাহিনীর পটভূমি এক দি ছুঁয়ে আছে মধ্যদেশ- অর্থ্যাৎ আজকের বিহার উত্তরপ্রদেশের কিছু-কিছু অঞ্চল, অন্য দিকে চিরকালীন মানুষের চিরজটিল মনোলোকে। এই দ্বিবিধ পটভূমিতে ভিন্ন ভিন্ন স্তরে ক্রমশ উন্মোচিত হয়েছে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী উপন্যাসের কথাবস্তু। কখনও রাজনৈতিক স্তরে যেখানে উত্তর -পশ্চিম থেকে পুবে আরও পুবে সরে আসছে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র, গান্ধার-মদ্র-কুরু-পাঞ্চালের জায়গায় কৌশল-বৈশালী-মগ্ধ, পুরনো সাম্রাজ্যেবাদের নীতির সঙ্গে ঘটছে নতুন মৈত্রী-ভাবনার সংঘাত। এই সংঘাতের কেন্দ্রে যেমন আছেন লোক বিশ্রুত গৌতম বুদ্ধ, আছেন ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট বলে খ্যাত বিম্বিসার ,কোশলপতি প্রসেনজিৎ ও নানান ধুরন্ধর রাজপুরুষবর্গ, তেমনই আছেন তক্ষশিলার বিদগ্ধ যুবক চণক, গান্ধাবের বিদুষী নটী জিতসোমা, তসাকেতের সন্ধিৎসু রাজন্যকুমার তিষ্য। কখনও-বা অর্থনৈতিক স্তরে, যেখানে ক্ষমতার প্রতিসরণ ঘটছে শ্রেণীবিন্যাসেও। ধনেই হয়ে উঠছে প্রকৃত ক্ষতমার উৎস। বাণিজ্যের সম্পসারণের সঙ্গে সঙ্গে শাস্ত্রজীবী এবং শস্ত্রীবীদের প্রতিযোগিতায় পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে আসছেন বণিক ও ধনজীবীরা। আবার সামাজিক স্তরে এদের সবাইকে ঘিরে বৃহত্তর জনজীবনে কৃষিজীবী, বৃত্তিজীবী, ভুশ্যধিকারী নাগরিক, ছোট ব্যবসায়ী, কবি, নটী, দাস প্রমুখের ক্ষেত্রে চলেছে শ্বাশ্বত জীবনচর্যা। তবু তার উপরেও পড়ছে পরিবর্তনের নানান সূক্ষ্ণ আঁচড়। বুদ্ধকথিত কখনও অনুকূল প্রভাব, কখনও বা প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া । আর এই সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ , আশা আকাঙ্ক্ষা, সাফল্য-বিপর্যয় , সম্পর্কের ভাঙন ও পুনর্বিন্যাসের অন্তঃশীল প্রবাহ । মনস্তাত্ত্বিক এই স্তর । এই চতুরঙ্গ স্তরের প্রতিচ্ছবির মধ্য দিয়ে মোহনার দিকে এগিয়ে যাওয়া এই উপন্যাসে কিংবদন্তি হয়ে ওঠা বহু ঘটনার ও অনুরূপ পরিস্থিতির নতুনতর ভাষ্য। আধুনিক জীবনের চোখে প্রাচীন জীবনের আপাত সরলতার মিথকে ছিন্ন করে এক অতি জটিল আবেগ-অনাবেগ, প্রেম-অপ্রেম, চেতন-অবচেতনের দ্বন্দ্বময় ব্যক্তি ও যৌথ-জীবনের কথা। যথোচিত ভাষায়, এবং যথাযোগ্য আঙ্গিকে।
আছে শুধু বড়-মাপের উপন্যাস নয় ‘মানবজমিন', প্রকারেও ব্যাপ্ত, বিশাল, বৈচিত্র্যময় । এ-যুগের অন্যতম শক্তিমান কথাকার শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের এ-যাবৎকাল প্রকাশিত যাবতীয় প্রধান রচনার প্রবল এক প্রতিস্পধী এই মহান উপন্যাস, আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের তাবৎ স্মরণীয় কীর্তিমালারও । ঐতিহ্যের সঙ্গে শিকড়ের যোগ এই দুর্লভ সৃষ্টির, সাম্প্রতিকের সঙ্গে আত্মার, আগামীর দিকে বাড়ানো এর কুঁড়ি-ধরানো ডালপালা । অসংখ্য ঘটনা, অজস্র চরিত্র, অফুরান সমস্যা এই উপন্যাসে। তবু কোথাও জট পাকায়নি। পরিণত লেখকের দক্ষ হাতের সুঠাম নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি চরিত্র ও কাহিনী সুস্থির, স্বতন্ত্র, লক্ষ্যাভিমুখী । লোভ, ঘূণা, প্ৰেম, রিপুর তাড়না, বাঁচার ইচ্ছে, উচ্চাকাঙক্ষা-এমন যে-সব কিছুর দ্বারা কুন্তীপাকে নিয়ত সিদ্ধ হচ্ছে মানুষ, তারই উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এই উপন্যাস । গড়ে উঠেছে মানুষে-মানুষে সম্পর্কের ভাঙচুর ও জোড়-মেলানো নিয়ে । অসংখ্য চরিত্রের ঘাত-প্ৰতিঘাতে দ্বন্দ্বময় এই উপন্যাসের অন্যতম নায়ক দীপনাথ, যাবতীয় চরিত্রের মধ্যে এক সাধারণ যোগসূত্রের মতো যে কিনা অবর্তিত, যার লড়াই চলেছে কর্মক্ষেত্রে । এক সওদাগরি আপিসের বিগ বসের পি. এ. দীপনাথ, আসলে এক বেতনভোগী ভূত্য । এই দীপনাথের সঙ্গেই তার বসের বউ মণিদীপার এক বিচিত্র সম্পর্ক গড়ে উঠল। আপাতভাবে রাগের, কিন্তু অন্তঃশীল অনুরাগের। বাস তাকে বিয়ে করার প্রস্তাবও দিয়েছিল। কিন্তু দীপনাথ কি সে-প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারবে ?
ফোনটা বাজছিল।
অন্য প্রান্তে ফোনটা কুরর- কুর কুরর- কুর করে কোনও মেঘলা দুপুরের কামাতুরা কবুতরের কথার মতো বাজছিল। শুনতে পাচ্ছিলাম। এখন রাত প্রায় সাড়ে ন’টা। টেলিফোনটা ওদের বাড়ির সিঁড়িব কাছে আছে। এখন বাড়িতে কে কে থাকতে পারে? সুজয় নিশ্চয়ই আড্ডা মারতে বেরিয়েছে। কদিন বাদে দোল। পাড়ায় দোল-পূর্ণিমার ফাংশন হবে। তাই নিয়ে পাড়ার রুস্তমরা ব্যস্ত। ফাংশন না কচু। ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে রেলিশ করে কিছু মেয়ে দেখা। রুস্তমদের রং ফিকে হয় না। বুকের লোম পেকে গেলেও না। বেশ আছে ওরা। টেরিলিন-টেরিকটে মোড়া বৃদ্ধ বালখিল্যের দল। নয়নার মা নিশ্চয়ই ঠাকুরঘরে চুপ করে বসে আছেন। এমন ভাব, যেন পৃথিবীর যাবতীয় ঘটনা-দুর্ঘটনা সব ওই ঠাকুরঘরের কস্ট্রোলরুম থেকেই রেডিয়ো কস্ট্রোলে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ফোনটা বাজছেই- বাজছেই- বাজছেই। নয়না এখন কী করছে? বোধহয় ঘুমুচ্ছে। সারাদিন পরিশ্রম তো কম নয়। নয়নার কথা ভাবলে আশ্চর্য লাগে। ওর সমবয়সি মেয়েদের পটভূমিতে ও বর্ষার জল-পাওয়া মৌরলা মাছের মতো লাফায়, অথচ ও আমার কাছে এলে শীতের সংকোশ নদীর ঘরেয়া মাছের মতো ধীরা হয়ে থাকে। আস্তে মাথা দোলায়, আলতো করে চোখ তুলে চায়, মুখে যত না বলে, চোখ দিয়ে তার চেয়ে বেশি কথা বলে। ওকে বুঝতে পারি না— ওকে একটুও বুঝতে পারি না। অথচ ওকে কী করে বোঝাই যে ওর এক চিলতে হাসি, ওর এক ঝিলিক চোখ চাওয়া- এইসব সামান্য সামান্য দান আমার সমস্ত সকাল, আমার সমস্ত দিন কী অসামান্য মহিমায় মহিমামণ্ডিত করে তোলে। গত পাঁচ বছর ধরে কখনও এ কথাটা ওকে বোঝাতে পারিনি- কিংবা ও বুঝলেও, না বোঝার ভান করে থেকেছে৷
বছর পনেরো আগে রােমরাম বসুর জীবন নিয়ে কিছু একটা লিখবার ইচ্ছা হয়, তখন ধারণা ছিল না যে তা ঠিক কি আকার ধারণ করবে। তার পরে বিষয়ের মধ্যে প্রবেশ করে বিস্মিত হয়ে গেলাম। রামরাম বসু প্রসঙ্গে উইলিয়াম কেরীকে পেলাম। বুঝলাম যে যে-সব মহাপ্ৰাণ ইংরেজ এদেশে এসেছেন, উইলিয়াম কেরী তাঁদের অগ্রগণ্য। কেরীর ধৰ্মজীবন, ধর্মপ্রচারে আগ্রহ, বাংলা গদ্য সৃষ্টিতে নিষ্ঠা ও অধ্যবসায় অভিভূত করে দিল আমাকে । তখন ধীরে ধীরে কেরী ও রামরাম বসুকে অবলম্বন করে কাহিনীটি রূপ গ্ৰহণ করে উঠল। এই কাহিনীকে পাঠক ঐতিহাসিক উপন্যাস বলে গ্ৰহণ করবেন। কিনা জানি না, করলে আমার আপত্তির কারণ নেই। ১৭৯৩ থেকে ১৮১৩ সালের ইতিহাস এর কাঠামো। জ্ঞানত কোথাও ইতিহাসের সত্য থেকে বিচ্যুত হইনি। কেবল একটি বিষয়ে কিছু স্বাধীনতা নিয়েছি, দ্বারকানাথ ঠাকুরের বয়স কিছু বাড়িয়ে দিয়েছি! আর কিছুই নয়, রবীন্দ্রনাথের পিতামহকে কাহিনীর মধ্যে আনবার লোভ সম্বরণ করতে পারি নি। ইতিহাসের সত্য ও ইতিহাসের সম্ভাবনা ঐতিহাসিক উপন্যাসকারের উপাদান। ইতিহাসের সত্য অবিচল, তাকে বিকৃত করা চলে না। ইতিহাসের সম্ভাবনায় কিছু স্বাধীনতা আছে লেখকের। সত্যের অপব্যবহার করি নি, সম্ভাবনার যথাসাধ্য সদ্ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছি। দুই শ্রেণীর নরনারীর চরিত্র আছে উপন্যাসখানায়, ঐতিহাসিক আর ইতিহাসের সম্ভাবনা-সঞ্জাত। কেরী, রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, টমাস, রামমোহন, রাধাকান্ত দেব প্রভৃতি ঐতিহাসিক চরিত্র। রেশমী, টুশকি, ফুলকি, জন স্মিথ, লিজা, মোতি রায় প্রভৃতি ইতিহাসের সম্ভাবনা-সঞ্জাত অর্থাৎ এসব নরনারী তৎকালে এইরকমটি হত বলে বিশ্বাস। এখানে যেমন কিছু স্বাধীনতা আছে, তেমনি ভুলের সম্ভাবনাও বর্তমান। ভুল না করে স্বাধীনতার সুযোগ গ্রহণে লেখকের ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে ক্ষমতা কতটা প্ৰকাশ পেয়েছে জানি না | পাত্ৰপাত্রীর উক্তিকে লেখকের মন্তব্য বলে গ্ৰহণ করা উচিত নয়। সে-সব উক্তি পাত্রপাত্রীর চরিত্রের সীমানার মধ্যেই সত্য, তাদের সত্যের সাধারণ রূপ বলে গ্ৰহণ করলে লেখকের প্রতি অবিচার করা হয়। বলা বাহুল্য, কোন ধর্ম কোন সম্প্রদায় বা কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তিকে আঘাত দেওয়ার উদ্দেশ্য এ গ্রন্থের নয়। তার চেয়ে উচ্চতর আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে লেখক। একটা সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পর্বের কয়েকটি বিশেষ নরনারীর সুখদুঃখের লীলাকে অবলম্বন করে নির্বিশেষ মানবসমাজের সুখদুঃখের লীলাকে অঙ্কন লেখকের উদ্দেশ্য। সে উদ্দেশ্য সফল হয়েছে এমন দাবি করি নাকিন্তু উদ্দেশ্য ও ছাড়া আর কিছু নয়। আরও একটা কথা বুঝলাম বিষয়ে প্রবেশ করে আর কাহিনীটা লিখতে গিয়ে— কলকাতা শহরের প্রাচীন অংশের প্রত্যেক পথঘাট, অট্টালিকা, উদ্যান, প্রত্যেক ইষ্টকখণ্ড বিচিত্ৰ কাহিনীরসে অভিষিক্ত । এ শহরের একটি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আছে যা ভারতের প্রাচীন শহরগুলোর ব্যক্তিত্ব থেকে স্বতন্ত্র। ভারতের প্রাচীন ও নবীন যুগের সীমান্তে অবস্থিত এই শহর। এর অনেক ক্রুটি সত্ত্বেও না ভালবেসে পারা যায় না। একে, কারণ এ আমার সমকালীন । সমকালীনতার দাবি এ শহরের সকলের প্রতি। “কেরী সাহেবের মুন্সী'রও ঐ দাবি-তদধিক কোন ঐশ্বর্য এর আছে মনে হয় না।
‘অলীক মানুষ’ বইয়ের প্রাপ্ত পুরস্কার গুলির নাম ও সালঃ
* ভুয়ালকা পুরস্কার - ১৯৯০
* বঙ্কিম স্মৃতি পুরস্কার - ১৯৯৪
* সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার - ১৯৯৪
* সুরমা চৌধুরী মেমোরিয়াল আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কার - ২০০৮
The great philosophies of Dualism and Monism had their origin in the teachings of Srimat Nimbarkacharyya Dhananjay Das Kathiababa is the worthy successor of this great philosophical school. Ascholar extraordinary, hs is a charming speaker. Thousands of listeners drink the nectar of his speech as if in a trance. His love is magnanimous and his heart is as tenders as flowers. Revered alike at home and abroad, Brindabanbihari Dasji got his Ph.D. from Benaras Hindu University. In sprite of inspiring a generation of countless devotees and followers with his intuitive lectures, he lives saintly life desisting the path of cheap publicity. The divine birth and life of Brindabanbihari Dasji has been narrated briefly in this book.
হাওড়া থেকে আগেই খবরটা পেয়েছিল অমলেশ; এই ডাউন লােকাল ট্রেনটা রাত এগারােটায় বীজপুরে পৌঁছুবে। অত রাতে বাঙলাদেশের সুদূর অভ্যন্তরে এক অচেনা শহরে নবেন্দুদের বাড়িটা আবিষ্কার করা সহজ হবে না। তা ছাড়া দ্বিতীয় ঋতুর আকাশ মেঘ-বিদ্যুৎবাজ আর জোরালাে ঝােড়াে হাওয়া, চতুরঙ্গে যেভাবে সেজে আছে তাতে কখন কী হবে কিছুই বলা যায় না; যে কোন মুহূর্তে শুরু হয়ে যেতে পারে। সব জেনেও সব বুঝেও অমলেশ বীজপুরের ট্রেনে উঠে বসেছে।
ফাল্গুনের আধাআধি কেটে গেলেও সকালের দিকে রােদে তেমন ধার নেই। মিহি সিল্কের মতাে কুয়াশার পটি আকাশের কানাতে কি গাছপালার মাথায় কিংবা ফসলের মাঠে আবছাভাবে ছড়িয়ে থাকে। এখনও বাতাসে হিমের আমেজ মাখানাে। গায়ে লাগলে শিরশির করে। ইতি’র পর পুনশ্চ'র মতাে উত্তর বিহারের এই অঞ্চলে শীতের খানিকটা জের থেকেই গেছে। ফাল্গুনের এই সকালে পুরনাে মডেলের বিরাট বিরাট চাকাওলা, হুডখােলা একটা মােটর হাইওয়েতে ঝড় তুলে পুব দিকে ছুটে যাচ্ছিল। ওটা যাবে ধরমপুরা টাউনে। গাড়িটার রুণ ঝরঝরে ইঞ্জিনে হাজারটা গলদ। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হলে যেমন হয়, অনবরত সেইরকম সাঁই সাঁই আওয়াজ বেরুচ্ছে ওটার ফুসফুস থেকে।
আমাদের সাহিত্য সাপ্তাহিক ‘হােমানল’ থেকে একটা প্রবন্ধ প্রতিযােগিতার আয়ােজন হয়েছে, ফলাফল ঘােষণা হবে পুজো সংখ্যায়। পুরস্কারের অঙ্কটা নেহাত ফেলনা নয়। মনটা নিশপিশ করল, কে না কে হয়তাে ফার্স্ট প্রাইজটা লুটে নেবে বনগাঁয়ের শেয়াল রাজা’ হয়ে, অথচ ভাল লিখিয়েরা এ-প্রতিযােগিতা গ্রাহ্যও করবে না। ছুটে গেলাম আমাদের তারকদার কাছে।
খুব ভােরে ঘুম ভাঙার দরুন, কিছুটা ঘুম চোখের পাতায় থেকেই যায়। সেই ঘুমটাকে নিয়ে সুখেন্দু এখন চেয়ারে বসে। ইদানীং স্বপ্ন-টপ্নগুলাে এই ছােট্ট ঘুমের মধ্যেই দেখে। শর্ট ফিল্মের মতাে। পাতলা ঘুমের স্বপ্নগুলােকে নিজেই অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এখন যে স্বপ্নটা সুখেন্দু দেখছে সেটা হল, সে বেশ কিছু টাকা লটারি, শেয়ার অথবা যে কোনওভাবে পেয়েছে। সেই টাকায় ও ভারতভ্রমণে বেরিয়েছে। কোনও এক দূরগামী ট্রেন। জানলার পাশে সিট। এক মুখ দাড়ি-গোঁফ, পরনে জিনসের প্যান্ট আর সুতির জামা। ট্রেনের হাওয়ায় চুলগুলাে এলােমেলাে উড়ছে...এই স্বপ্নের মধ্যেই সুখেন্দু সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না ওর চোখে একটা চশমা থাকবে কি না! এই সময় কেউ যেন ওপাশের বাঙ্ক থেকে বলল, শুনছেন।
মিশর আমাদের কাছে পিরামিড স্ফিংকস টুটেনখামেন আর ক্লিওপ্যাট্রার দেশ। প্রাচীন, রহস্যময়ী। তার অস্তিত্বই পরম বিস্ময়। মরুভূমির প্রচণ্ড প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মধ্যে একটি নদীর কৃপায় সভ্যতার স্ফুরণ। ছােটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে পড়া মিশর নীলনদের দান। তার ইতিহাস আমাদের অজানা। আধুনিক মিশর—নাসের নেহরু পঞ্চশীল সুয়েজখাল আসােয়ান বাঁধ সংবাদপত্রে খবর। ভূগােলকে অগ্রাহ্য করে দূর-দূরান্তর ইউরােপ আমেরিকার চেয়ে নিকটের মিশর আমাদের কাছে অচেনাই থেকে গেছে।
খিদিরপুরে শেষ কবে গিয়েছিল মনে নেই। বাস থেকে নেমে অমলের মনে হচ্ছিল, সে বিহার অথবা উত্তরপ্রদেশের কোনও শহরে পৌঁছে গিয়েছে। বাসটা থেমেছিল খাল পেরিয়ে বাজারের পাশে। সেখান থেকে খানিকটা এগােতেই তিন মাথার মােড়টা দেখতে পেল অমল। এই মােড়েই তাকে আসতে বলেছিল রবীন। মােবাইলে সময় দেখল সে, এখনও দশ মিনিট বাকি আছে চারটে বাজতে।
সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দী জুড়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল ব্রিটেন ও এশিয়ার বৃহত্তম এবং সবথেকে ক্ষমতাশালী ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। কোম্পানির প্রতিষ্ঠা হয় ব্রিটেনের বাজারের জন্যে এশিয়ার পণ্য কিনবার উদ্দেশ্য নিয়ে। এই কেনাবেচার পরিণাম পারস্য থেকে ইন্দোনেশিয়া, এশিয়া থেকে উত্তর আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত এক নেটওয়ার্ক। অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে প্রায় নাটকীয়ভাবে কোম্পানি ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ফেলল।রাজনীতি ও বাণিজ্যের মধ্যে যে জটিল পরস্পরনির্ভরতা থেকে ভারতে ব্রিটিশ রাজের শুরু, তাই নিয়ে এই বই। সাম্প্রতিক গবেষণা ও ঐতিহাসিক তথ্যের সমন্বয় করে লেখক আরও দেখিয়েছেন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসে কোম্পানির তাৎপৰ্য কোথায়, কীভাবে উনিশ শতকের বিশ্বায়ন ভারতে ব্যাবসার কাঠামো বদলে দেয়, আর এই পরিবর্তনের প্রভাব কেন সুদূরপ্রসারী।
এই দুর্দান্ত কৌতূহলকর থ্রিলারের পটভূমি ভারতবর্ষের কাছাকাছি এক পাহাড়ী রাজ্য। একনায়কতন্ত্রী শাসনব্যবস্থাধীন এই রাজ্যের স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে তলে-তলে চলতে থাকে বিপ্লব সংগঠনের প্রয়াস। আকাশলাল ছিল এই বিপ্লববাহিনীরই নেতা। প্রশাসনিক তৎপরতায় বিদ্রোহ দমিত হল; গা ঢাকা দিল আকাশলাল ও তার প্রধান সঙ্গীরা। পুলিশের জাল কেটে বেরুতে গিয়ে একে-একে নিহত হল আকাশলালের সঙ্গীরা। অবশেষে একদিন আকশলালও হল বন্দী। পুলিশী হেফাজতে আকস্মিক মৃত্যু ঘটে গেল আকাশলালের। সম্ভাব্য জনরোষ ও উত্তেজনা এড়াতে চুপিচুপি কবর দেওয়া হল তাকে। আশ্চর্য, কীভাবে যেন আবার একদিন ফিরে এল অমর বিপ্লবী আকাশলাল। কীভাবে? আট কুঠুরি ও নয় দরজার কী সেই অনন্য রহস্য যার সহায়তায় মৃত্যুকেও জয় করল আকাশলাল?
মৌষলকাল - সমরেশ মজুমদার....... সত্তরের নকশাল রাজনীতিতে অনিমেষের জড়িয়ে পড়া এবং পুলিশি অত্যাচারে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার কাহিনি তুমুল এক ইতিহাসের কথাই বলে। সমরেশ মজুমদার এই চরিত্রটিকে নিয়ে তিনটি বিখ্যাত উপন্যাস রচনা করেছেন, যা ধারণ করে আছে পশ্চিমবঙ্গের অনতি-অতীতকালের রাজনৈতিক-সামাজিক সময় প্রবাহ।অনিমেষের বান্ধবী হিসেবে সময়ের সঙ্গে যুঝেছে মাধবীলতা। সময়ের ফসল হিসেবে এসেছে তাদের সন্তান অর্ক। বড় হয়ে অর্কও দুঃখী মানুষদের নিয়ে সাধ্যমতো স্বপ্নপ্রয়াসে জড়িয়ে পড়েছে এবং ব্যর্থ হয়েছে যথারীতি। সর্বত্রই ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দল হিংস্র থাবা নিয়ে তৈরী।
এ কাহিনী এক আশ্চর্য মেয়ের অদ্ভুত জীবনকে কেন্দ্র করে। সম্বন্ধ করে সে মেয়ের বিয়ে হল এমন এক পাত্রের সঙ্গে, আপাতদৃষ্টিতে যাকে মোটেই ফেলনা বলা যায় না। এম-এ পাশ, বি-এতে অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস নম্বর ছিলম মোটামুটি সচ্ছল ও স্থায়ী চাকুরে, সপ্রতিভ সুন্দর চেহারা, মুখ আর হাসি শিশুর মত পবিত্র। বিয়ের আগে তেমন খোঁজখবর নেওয়া হয়নি, বিয়ের পর জানা গেল, ছেলেদেরে পাগলের বংশ। দুই দাদা বদ্ধ পাগল, ভাইটি অবশ্য তখনও সুস্থ, কিন্তু কতদিন? এমনই এক মেয়েকে নিয়ে এই কাহিনী। এত বড় নিষ্ঠুর পৃথিবীতে শিশুর মত সরল, ছেলেমানুষ স্বামীকে যে কিনা ছেড়ে দিতে চায়নি, জড়িয়ে গিয়েছিল এক অদ্ভুত মায়ায়- তেমনই এক মেয়ের ঘাতপ্রতিঘাতময় জীবনের দুরন্ত কাহিনী।