রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র ও বহুমুখী কীর্তির মধ্যে তার একটি পরিচয় যেন একটু চাপা পড়ে গেছে বলে মনে হয়। সেটি হল তার সমালােচনা। এটা খুবই বিস্ময়কর এইজন্য যে তার সমালােচনাত্মক রচনা তার সাহিত্যরচনাবলীর একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। “সাহিত্যের পথের ভূমিকায় কবি নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছেন, রসসাহিত্যের রহস্য নিয়ে অনেক কাল থেকেই আগ্রহের সঙ্গে আলােচনা করে আসছি। এই ‘অনেক কালটা’ কত কাল, সনতারিখ একটু মিলিয়ে দেখলেই দেখা যাবে সেটা প্রায় সারাজীবন, অন্তত সাহিত্যজীবন তাে বটেই।
“জঙ্গল-মহল” একেবারে মন-মৌজী লেখা। কোনাে মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে নয়। বনে-পাহাড়ে বন্দুক কাঁধে, বিচিত্র ও বিভিন্ন লােকের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানাের যে আনন্দ, সেই আনন্দই বিকিরণের চেষ্টা করেছি মাত্র। এই সংকলনের পাঠক-পাঠিকারা যদি সামান্যতম আনন্দও পান, তবেই জান আমার অরণ্য-বিলাস অসার্থক হয়নি। শ্রীমতী ঋতুর সানন্দ সম্মতি না থাকলে লেখার মত অন্তর্মুখী শখ অংকুরেই বিনষ্ট হত। রুজি রােজগারের পর যে অতি সামান্য সময় উদ্ধৃত্ত থাকে তার একটা বড় অংশ লেখার শখে নির্বিবাদে ব্যয় করতে দেওয়ায় আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। তাছাড়া এই বই প্রকাশ করেছেন তিনিই।
ছড়ানাে কমপাউন্ডের মধ্যিখানে বিশাল তেতলা বাড়িটার আগাপাশতলা সেকেলে অর্কিটেকচারের ছাপ। পুরু পুরু ছত্রিশ ইঞ্চি দেওয়াল। সেগুন কাঠের চওড়া চওড়া, মজবুত দরজা। জানালায় দু’টো করে পাল্লা। সেগুলাের একটায় খড়খড়ি, অন্যটায় রঙিন কাচ বসানাে। উঁচু উঁচু সিলিংয়ে পঙ্খের কাজ। বাড়িটার সামনে এবং পেছনের ফাঁকা জায়গায় একসময় খুব যত্ন করে বাগান করা হয়েছিল। দামি দামি, দুর্লভ গাছ কবেই হেজেমজে গেছে।
ছুটির দিনের এই দুপুরবেলায় রাস্তায় লােকজন খুব কম। গাড়ি টাড়িও বিশেষ চোখে পড়ে না। যা দু-একটা দেখা যাচ্ছে সেগুলাের সারা গায়ে আলস্য মাখানাে। যেন কোথাও যাবার তাড়া নেই তাদের; গড়িমসি করতে করতে এগিয়ে চলেছে। নভেম্বর মাস শেষ হয়ে এল। কলকাতা মেট্রোপলিসের ওপর দিয়ে কনকনে উত্তুরে হাওয়া ঘােড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে। আকাশ একেবারে পরিষ্কার ; কোথাও মেঘের চিহ্ন নেই। সূর্য সরাসরি মাথার ওপরে উঠে এসেছে। শীতের ঠাণ্ডা সােনালি আলােয় ঝলমল করছে চারিদিক।
একদিকে চন্দন রঙের পদ্ম, আর একদিকে কালীয়নাগের মতাে মেঘনা। চন্দনা পদ্ম | মেঘবতী মেঘনার জলে একটা উচ্ছল গানের কলির মতােই ভেঙে পড়ে। উত্তাল ঢেউয়ে ঢেউয়ে টলমল করে ডিঙি-ডােঙা, শালতি-মাল্লাই, হাজারমণি মহাজনী নৌকো। ব্যাপারীদের ভাউলে আসে উত্তর দিগন্ত থেকে। খেকরি আখ, রসগুড়, সবরী আম, এমনি নানান জিনিসের চালান নিয়ে। যাযাবার পাখির মত পালের পাখনা মেলে অদৃশ্য হয়ে যায় কেরায়া নৌকোর মিছিল, ‘গয়নার নাও’-এর সারি।
সাইকেল রিকশায় উঠতে গিয়ে ফ্যাঁস করে শাড়ি ছিড়ে গেল বিশাখার। বেশ অনেকটা। সঙ্গে সঙ্গে বিশাখার বুকে এমন একটা কষ্টের অনুভব হল, অনেক মূল্যবান কিছু হারালেও ততটা হয় না। প্রত্যেক শাড়িরই দু’রকম আয়ু থাকে, প্রথম হল পছন্দের আয়ু, দ্বিতীয় হল তার টিকে থাকার আয়ু। আচমকা এভাবে ছিড়ে গেলে সেটা যেন অপমৃত্যু। কোনও প্রিয়জনের বিমান দুর্ঘটনার মতন।
আমার একদিকে গড়বন্দীপুর, আর দিকশূন্যপুর অন্য দিকে। মাঝেমাঝেই আমি গড়বন্দীপুরে আটকা পড়ে যাই। এই যখন একটা বাচ্চা ছেলে অপহরণ আর খুন হয়। আমি গড়ের দেওয়ালে মাথা ঠুকি একজন অপদার্থ মানুষের মতন কিছুতেই বেরুতে পারি না ।
মার্চের দশ তারিখ হয়ে গেল। কিন্তু এখনও দেখছি দু এক দিন অন্তর অন্তরই। ব্রুকলিনের আকাশ তুষার ঝরিয়ে চলেছে। পনেরটা শীতের মধ্যে তেরটাই আমাদের কেটেছে দক্ষিণে যেখানে কর্কটক্রান্তি নিকটবর্তী হওয়ার দরুন আবহাওয়া অনেকটা নম্র। শীতটা শুধু একটু কড়া। দিল্লির শীতের মতাে। তা-ও জানুয়ারীর পরই শীত পাততাড়ি গুটোয়। এতাে তুষার বা ব্লিজার্ড আমাদের অভ্যেস নেই। বৃষ্টিপাতের মতাে তুষারপাতও আমার মতে কাচের আড়াল থেকে উপভােগ করবার জিনিস। বেরােতে হলেই চমৎকার ! গত বছরটা শীতের মরশুমে পালিয়েছিলুম অস্ট্রেলিয়ায়।
দীর্ঘ পনের বছর পর এক বিখ্যাত, পেশাদার, রঙ্গমঞ্চে কৃতজ্ঞ মক্কেলের নিবন্ধাতিশয্যে থিয়েটার দেখতে গিয়ে অপ্রত্যাশিত ভাবে সংহিতা দত্তগুপ্তর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। যাত্রা-থিয়েটার-গানের আসর ইত্যাদি সাংস্কৃতিক চিত্তবিনােদনের অবসর বা সুযােগ কোনটাই আমার আজকাল আর হয়ে ওঠে না। প্রত্যেকটি অনুপল বিপল ব্রীফ দিয়ে ঠাসা। কারণ শুধু অন্নচিন্তা নয়, অর্থলালসাকেও পুরােপুরি দায়ী করা যায় না। আসলে, সব দায়িত্বশীল বৃত্তিরই আমিষাশী উদ্ভিদের মতাে কতকগুলাে আঠাল আকৰ্ষ থাকে যাদের সাহায্যে বৃত্তিজীবীকে ধীরে ধীরে তারা নিজস্ব পরিপাক যন্ত্রের কেন্দ্রে টেনে নেয়।
বাড়িতে দোতলায় একটা নতুন ঘর উঠবে তাই একটা ঠেলাগাড়ি করে ইট আসছে ইট ভাটা থেকে। বেলা দশটা। প্রথম দফার তিনশাে ইট বাড়ির সামনে এনে এক্কাওয়ালা নন্টু সেখ হই হই চেঁচামেচি বাধিয়ে তুলল! “বাবু কোথায়? বলি মিস্ত্রি কেডা? আরে ইট ডেলিভারি নেবে
অন্ধ যুবক, একটু বেঁটে, মাথা ভরা আঁকড়া চুল। মুখমণ্ডলে এখনও কিছুটা লাবণ্য আছে। জমিদারের পূর্ব ঐশ্বর্য নষ্ট হয়ে গেলেও তার প্রাসাদটা যেমন পথিকের দৃষ্টিতে পড়ে স্মরণ করিয়ে দেয় আড়ম্বরের কথা; ক্ষীয়মান ঐশ্বর্য যেমন দম্ভটাই রেখে যায়, তেমনি ভিখারীর চেহারাটাও ক্ষুধায়, অত্যাচারে নষ্ট হয়ে গেলেও সূর্যের শেষ রশ্মিটুকুর মত তার ক্ষীয়মান সৌন্দর্যও মনে করিয়ে দেয় যে, তা একদিন প্রকৃতই লাবণ্যময় ছিল।
বিনয়েন্দ্র ছিলেন ইন্দ্রিয়সুখে আচ্ছন্ন মানুষ। জীবনদর্শন সহজ, “মেজাজটাই তাে আসল রাজা,আমি রাজা নয়।” নানাবিধ দুর্লক্ষণ ছিল মেজাজের। দিনরাতের অধিকাংশ সময় ‘জলপথেই থাকতে পছন্দ করতেন। উদ্দাম নারীসঙ্গ স্বভাবগত, নিয়মিত নিশিযাপন বালিকাবালা এবং চঞ্চলা নামে দুই রক্ষিতার সাহচর্যে। প্রমােদবিলাসে মাঝেমধ্যে পাড়ি দিতেন বােম্বাই। রুপােলি পরদার রংবাহারে বরাবরের আকর্ষণ। সংযম এবং শৃঙ্খলা, দুইয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন কৈশােরেই।