সূচিপত্র
গোলাপের ইতিবৃত্ত
* গোলাপ বিসংবাদ
* গোলাপচিত্র
* গোলাপ নিয়ে আলাপ সালাপ
* কবি বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে গোলাপ নিয়ে একদিন
* গোলাপচিত্র
* ছোটগল্প: পটভূমিতে গোলাপ
* গোলাপধোলাই
* ফানুস
* গোলাপচিত্র
* রচনা: প্রসঙ্গ গোলাপ
* বুনোগোলাপের সুখদুখ
* দশ মিনটে গোলাপের কথা
* আরো গোলাপ
* গোলাপচিত্র
এবারের বর্ষশেষে সেই চিন্তা আবার তার মাথায় এসেছে, এবং খানিকটা খেয়ালবশেই সে কিয়ােটো যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। এত বছর পরে উয়েননা ওতােকো-কে আবার একবার দেখা এবং তার সঙ্গে একত্রে ঘণ্টাধ্বনি শােনার এক অবাধ্য ইচ্ছাও তাকে এবার কিয়ােটোর পথে টেনে এনেছে। কিয়ােটো চলে আসার পর ওতােকো তাকে আর লেখেনি কখননা, কিন্তু এতদিনে সে নিজেকে ঐতিহাসিক জাপানি ধারার একজন খ্যাতিমান চিত্রকর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। এখনাে সে অবিবাহিতই রয়ে গেছে। ঝোঁকের মাথায়ই যেহেতু কাজটি করে ফেলেছে, এবং পূর্বে থেকে আসন-সংরক্ষণ ওকির একদম অপছন্দ, তাই সােজা ইয়ােকোহােমা স্টেশনে হেঁটে গিয়ে সে কিয়ােটো এক্সপ্রেসের পর্যবেক্ষণ কামরায় চেপে বসেছে। ছুটির সময় ট্রেনে এখন ভিড় হতে পারে, কিন্তু গার্ডকে সে চিনত এবং তার মাধ্যমে কোনাে রকমে একটা সীট পেয়ে যাবে এমন ভরসা ছিল।
তিনি বললেন, ‘মশাই, আপনি আমাকে অত্যন্ত গর্হিত কাজ করতে বলছেন। আপনি কি জানেন না প্রত্যেক ডাক্তারের পবিত্র কর্তব্য তাঁর মক্কেলদের গােপন কথা সযত্নে গােপন রাখা? জানেন না আপনার অকারণ কৌতূহল চরিতার্থ করতে হলে আমাকে কী জঘন্য অপরাধে অপরাধী হতে হবে? এত বয়স হয়েছে অথচ এটুকু জানেন না, গােপনীয়তা রক্ষা করা ডাক্তারদের অবশ্য কর্তব্য? না মশাই, আপনার বেয়াড়া প্রশ্নের জবাব আমি দেব না। আপনাকে অনুরােধ করতে বাধ্য হচ্ছি, এই মুহূর্তে আপনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। ঐ যে বেরােবার দরজা।'
আর ক্ষতির, সম্পদ আর দারিদ্র্যের, উত্থান আর পতনের এক সীমাহীন চক্র। আমাদের পরিবারের কথা বাদ দিয়ে, বলেছিল যেনাে, সেটা আবার সম্পূর্ণ আলাদা একটা ব্যাপার। আমাদের পরিবারকে বড়জোর কোনও রেইলওয়ে টাইম টেবলের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে: একজন বিদায় নিচ্ছে, সে চলার পথে থাকতে থাকতেই ফিরে আসছে আরেকজন, সে যখন প্রত্যাবর্তন নিয়ে ব্যস্ত, অন্যরা সেসময় নতুন কোনও যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে। স্বাভাবিক পরিবারগুলাে শত শত বছর ধরে একই জায়গায় থাকে,' বলেছে যেনাে। যদি কখনও জায়গা বদলায়, সেটা ঐতিহাসিক একটা ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। আর আমাদের পরিবারের বেলায় মাত্র আধপ্রজন্ম পরেও যদি আমরা নতুন জীবনের বদলে অবকাশের সঙ্গে স্যুটকেসকে মেলাই, সেটাই হবে ঐতিহাসিক ব্যাপার।
জীবনে যে দুর্দশা বয়ে গেছে, তার প্রভাবে বিষন্ন আর মনমরা হয়ে পড়েছিলাম। একাডেমিক পড়াশােনা আর নিবিড় ধর্মচর্চার মাধ্যমে ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে এল। অনেকের কাছে আমার সে চর্চা অদ্ভুত মনে হতে পারে জেনেও তা চালিয়ে গেলাম। টরন্টো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম এক বছর হাই স্কুলে পড়ার পর । সেখানে ডবল-মেজর ব্যাচেলর ডিগ্রি নিলাম। আমার দুই মেজর ছিল ধর্মতত্ত্ব এবং প্রাণীবিদ্যা। ফোর্থ ইয়ারে ধর্মতত্ত্বে আমার থিসিসের বিষয় ছিল ষােড়শ শতকের মহান কাব্বালাপন্থী সাফেদের আইজ্যাক লুরিয়ার সৃষ্টিতত্ত্বের সুনির্দিষ্ট কয়েকটি দিক। অন্যদিকে প্রাণীবিদ্যায় থিসিসের বিষয় ছিল তিন আঙ্গুলের পা-ওয়ালা থের থাইরয়েড গ্রন্থির ক্রিয়াকর্মের বিশ্লেষণ। শ্লথকে বেছে নেওয়ার কারণ এটির শান্ত, সৌম্য ও নিমগ্ন চলাফেরা আমার ভগ্নহৃদয়ে কিছুটা সান্ত্বনা যােগাতাে।
ঈশ্বরের ইচ্ছে হলে যদি আমি বেঁচে থাকি দেখতে তুমি এসব পড়ছাে যদি আমি | তােমার সেই বিস্ময় মনােভাব দেখার সাক্ষ্য হতে পারি যখন তােমার কালাে চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হবে এবং তােমার চোয়াল ঝুলে পড়বে যখন তুমি বুঝতে পারবে কিভাবে এই পৃথিবীর অবিচার একজন হতভাগা আইরিশ বর্তমান যুগে সহ্য করেছে। যখন তােমার কাছে সবকিছু অদ্ভুত মনে হবে। সব কিছু মনে হবে আর এক দেশের গল্প কারণ এইসব কর্কশ শব্দ এবং অত্যাচার যা মানুষকে প্রাচীন কালে করা হতাে যা এখন আর নেই সেই যন্ত্রণা আমি আমার বর্তমান লেখায় এবং আমার জীবনের সঙ্গে মেলাবাে।
‘না’, আমার ভেতর থেকে কেউ তক্ষুণি আপনাআপনি চিৎকার করে ওঠে যখন আমার স্ত্রী (ঘটনাক্রমে এখন সে আর আমার স্ত্রী নয়) প্রথম উল্লেখ করেছিল - তাের কথা- আর আমার গােঙানি কেবল ধীরে ধীরে কমে এসেছে, হ্যা আসলে বহু বছর গড়িয়ে যাওয়ার পরই কেবল, এই গােঙানি শেষনাগাদ পরিণত হয়েছে এক চরাচরব্যাপি বিষাদে, ঠিক যেমনটা সেই বিশ্ববিশ্রুত বিদায় দৃশ্যে উয়ােটানের উন্মত্ত ক্রোধ, অবশেষে উত্তরের আলাের ছায়া থেকে ধীরেধীরে মৃদু অসুস্থতার মতাে একটি প্রশ্ন আমার মধ্যে আকার পেয়েছে আর তা হচ্ছে,
শিউরে উঠে ম্যাপের বিস্তারিত দেখার জন্যে তাকাল বার্ড। আফ্রিকাকে ঘিরে থাকা সমুদ্রের রঙ দেয়া হয়েছে শীতের ভােরের আকাশের জলাে নীল। অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশ কম্পাসে আঁকা যান্ত্রিক রেখা নয়: চওড়া টানগুলাে শিল্পীর অস্থির মন আর খেয়াল প্রকাশ করেছে। খােদ মহাদেশটাকে দেখাচ্ছে কোনও মানুষের ঝুলিয়ে দেয়া মাথার খুলির মত। শােকার্ত হতাশ চোখের কোনও লােক বিশাল মাথা নিয়ে চেয়ে আছে কোয়ালা, প্লাটিপাস আর ক্যাঙ্গারুর দেশ অস্ট্রেলিয়ার দিকে। ম্যাপের নীচের দিকের কোণে জনসংখ্যার বণ্টন দেখানাে খুদে আফ্রিকার ম্যাপটিকে পচনশুরু-হওয়া কোনও মরা মানুষের মাথার মত দেখাচ্ছে। রাস্তাঘাট আঁকা আরেকটা ম্যাপ যেন ছাল খসানাে খুলি, রগটগ নির্দয়ভাবে উন্মুক্ত করা হয়েছে।
এমন সময় আসে যখন আমি নিজেকে প্ররােচিত করার চেষ্টা করি যে আমিই টিকে থাকা একমাত্র পােট্রেট চিত্রশিল্পী এবং আমি চলে গেলে কেউই আর এই বিরক্তিকর বৈঠকে একটুও সময় ব্যয় করবে না অথবা সাদৃশ্য অর্জনের সামান্যতম বৃথা চেষ্টাও করবে না, যখন আলােকচিত্র ফিল্টার এবং ইমালশন ব্যবহারের মাধ্যমে একটা শিল্প কাঠামােতে পরিণত হয়েছে, অবস্থাদৃষ্টে উপরিপৃষ্ঠ ভেদ করে মানব সত্তার প্রথম অন্ত:স্তর প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সেটাকে অনেক বেশী কার্যকরী প্রতীয়মান হয়। এই ভাবনাটা আমার হাসির কারণ ঘটায় যে আমার পতন প্রবণতার কারণে আমি একটি অধুনালুপ্ত শিল্পকলার পশ্চাদ্ধাবন করে ফিরছি, যেটা ধন্যবাদের যােগ্য,
অপেক্ষা করুন তিনি। রাতের মত অবসর নেয়ার আগে এখনও নিজেকে প্রস্তুত করছেন রাজা। তার ফুটম্যানরা পােশাক খুলতে সাহায্য করেছে তাকে এবং উপযুক্ত আনুষ্ঠানিক রােব চাপিয়ে দিয়েছে তাঁর গায়ে। প্রত্যেকটা কাপড় এমন শ্রদ্ধার সঙ্গে একহাত থেকে অন্যহাতে যাচ্ছে যেন ওগুলাে হােলি ভার্জিনের রেলিক্স। এই পর্বটুক অন্যান্য ভূত্য আর কিশাের পরিচারকদের উপস্থিতিতে সারা হচ্ছে। একটা বিশাল চেস্টের মুখ খুলে ধরছে একজন; অন্যজন পর্দা টেনে সরাচ্ছে, মোমবাতি উঁচু করে ধরছে একজন, আর আরেকজন সলতে ঠিক করছে; সােজা হয়ে দাঁড়াল দুজন ফুটম্যান, আরও দুজন হাত মেলাল; ওদিকে নির্দিষ্ট কোনও দায়িত্ব ছাড়াই পটভূমিতে জটলা পাকিয়ে আছে আরও বেশ কয়েকজন। দীর্ঘ সময় শেষে, ওদের সম্মিলিত প্রয়াসের কল্যাণে প্রস্তুত হলেন রাজা। উপস্থিত অভিজাতজনদের একজন শেষবারের মত একটা ভঁজ সােজা করে দিল, অন্য একজন ঠিক করে দিল এমব্রয়ডারী করা নাইট শার্ট। এখন থেকে যেকোনও মুহূর্ত ডােম হােয়াও পঞ্চম রানীর বেডচেম্বারের উদ্দেশে পা বাড়াবেন। পরিপূর্ণ হওয়ার প্রতীক্ষা করছে পাত্র।
আমার পক্ষে যতােটা সম্ভব, সব প্রধান চরিত্রের সাক্ষাৎকার আমি নিয়েছি। প্রতিটি সাক্ষাৎকারে আমি তাদের আন্তরিকতা ও আগ্রহ লক্ষ্য করেছি। যেসব ক্ষতস্থান তারা ঢেকে রাখতে চেয়েছেন তারা তা পুনরায় আমার জন্যে খুলে দিয়েছেন, ভুলে থাকতে চেয়েছেন যেসব স্মৃতি তা পুনরায় স্মরণ করেছেন। এই শেষ বয়সের কাজে, আমার জীবনের সবচেয়ে করুণ ও কঠিন এ কাজে তাদের বেদনা, তাদের ধৈর্য এবং তাদের ক্রোধ আমাকে সাহস যুগিয়েছে। আমার নৈরাশ্য শুধু এ কারণে যে, তারা বাস্তব জীবনে যে ভীতিকর অবস্থার মুখখামুখি হয়েছিলেন তার পুরােটা আমি বইতে ধারণ করতে পারিনি ;
দাদিমাকে গােসল করাতে ব্যস্ত এরেন্দিরা, তক্ষুনি দুর্ভাগ্যের কালাে হাওয়া গ্রাস করলাে তাকে। মরুভূমিতে চকচকে উজ্জ্বল চাঁদের মতাে দাদিমার বাড়ি। একাকি দাঁড়িয়ে থাকা সেই প্রাসাদ, ঝড়ের প্রথম আঘাতে ভিত্তিভূমিসুদ্ধ কেঁপে উঠলাে। কেমন এক বন্য দাঢ্যতায় এরেন্দিরা এবং তার বিশাল দাদিমা এসব ঝড় ঝাপটাকে উপেক্ষা করে স্নানের ঘরে ময়ূর পাখিদের ছবির মাঝে, সেই সুন্দর রােমান বাথটাবে সুস্থির মনে নিজেদের কাজে মগ্ন রইলাে।
বাড়িটার নাম ছিল সেডারস, অনেক পুরনাে। চারিদিক ঘিরে ছিল বড় বড় গাছ, বানরের গায়ের মতাে বাদামী ছিল ওগুলাের রঙ, গুঁড়িগুলাে এত বিশাল ছিল যে ভয় লাগত, এখনও বাঁদিকে ওদের শাখা-প্রশাখার বাড়-বাড়ন্ত, ওদিকটায় আছে একটা লন, যত্ন নেই, বাড়িটার একটা নক্সা করা জানালাও আছে এদিকে, বসার ঘর হিসেবে ব্যবহার হতে পারত ওটা কিন্তু মিস ভাভাসাের ওটাকে বলতেন মালকিনের ঘর। ওটার উল্টো দিকে ছিল বাড়িটার সদর দরজা, তেলের দাগ ধরা পাথুরে চত্বরের পরে ছিল লােহার একটা গেট, এখনও ওটার রঙ সবুজই আছে, তবে কোথাও কোথাও মরচে ধরে রঙ গেছে চোটে। আমার আশ্চর্য লাগছিল, গত পঞ্চাশ বছরে খুব একটা বদলায়নি কিন্তু শেষবার আমি এখানে এসেছিলাম পঞ্চাশ বছর আগে! আশ্চর্য তাে হচ্ছিলামই, কেমন অস্থিরও লাগছিল, আমি অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম, বলতে গেলে পালিয়েইছিলাম,
বৃদ্ধাবাসটি বাস রাস্তা থেকে দু’কিলােমিটার দূরে এক গ্রামে। আমি পথটা হাঁটলাম । বৃদ্ধাবাসে পৌছানাে মাত্র আমি মা-কে দেখতে চাইলাম। দারােয়ান জানাল, আগে বৃদ্ধাবাসের পরিচালকের সঙ্গে দেখা করুন। পরিচালক তখন কর্মব্যস্ত, তাই অপেক্ষা করতে হল। অপেক্ষা করার সময়ের পুরােটাই দারােয়ান নানা কথা বলতে থাকল। অবশেষে এল পরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পালা। তিনি তার অফিসে আমাকে ডেকে পাঠালেন । ঈষৎ বয়স্ক, লিজিয় দ্য অনার-এ (রাষ্ট্রীয় সম্মান) ভূষিত মানুষ। একটু বেশিক্ষণ সােজা তাকিয়ে আমাকে দেখলেন। অতঃপর করমর্দন করে আমার হাতটা এতক্ষণ। ধরে রাখলেন যে কতক্ষণে হাতটা নিষ্কৃতি পাবে অনুমান করতে পারলাম না। একটা ফাইল দেখে বললেন, “মাদাম মেরসল আমাদের এখানে তিন বছর আগে ভর্তি হয়েছিলেন।
প্রাঙ্গণের বিভিন্ন জায়গায় পাঁচ-ছটা দল নৃত্য পরিবেশন করছে। জনপ্রিয় ‘ইগাে উইমেন্স পার্টি’ দামী আক্ৰা কাপড়ের ইউনিফর্ম পরেছে । প্রচুর হইচই সত্ত্বেও আপনি তাদের একক সঙ্গীতশিল্পীর উচ্চনাদী কণ্ঠ শুনতে পাবেন, যাকে তারা প্রশংসা করে বলে গ্রামার-ফোন। ব্যক্তিগতভাবে আমি আমাদের মেয়েদের নাচ নিয়ে তেমন আগ্রহী নই। কিন্তু গ্রামার-ফোন যখন গাইবে তখন আপনাকে শুনতেই হবে। সে এখন মিকাহ-র সৌন্দর্যের প্রশংসা করছে, সে তার তুলনা করছে নিখুঁত, খােদিত ঈগলের ভাস্কর্য-সৌন্দর্যের সঙ্গে, তার জনপ্রিয়তা দূরগামী পরিব্রাজকের মতাে ঈর্ষণীয়, যে তার গমনপথে কোনােক্রমেই শত্রুতা তৈরি করে না। মিকাহ মানে অবশ্যই চীফ দ্য অনারেবল এমএ নাঙ্গা এমপি।
২০১০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কথাসাহিত্যিক মারিও ভার্গাস ইয়োসার বর্তমান অনূদিত উপন্যাসের স্প্যানিশ ভাষায় মূল গ্রন্থ ‘লা সিউদাদ ই লোস পেরয়োস’ প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে; আর তার ইংরেজি ভাষান্তর ‘দ্য টাইম অব দ্য হিরো’ নামে প্রকাশ পায় ১৯৬৩ সালে। মূল স্প্যানিশ বইটির বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘শহর আর কুত্তাগুলো’ যেখানে ইংরেজি নামকরণটি একটু বেমানান ঠেকে। বঙ্গানুবাদে তাই এ বইয়ের নামকরণ করা হলো, ‘সামরিক সারমেয় কথা’। মূল বইটি প্রকাশকালে লেখকের বয়স ছিল ছাব্বিশ। পেরুর রাজধানী লিমা শহরের লিওনসিও প্রাডো সামরিক আবাসিক স্কুলে পাঠরত অবস্থায় শারীরনির্যাতন আর চরিত্রহীনতার যে দুঃসহ অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছিল এই বইয়ের প্রেক্ষিতে তারই তিক্ত প্রতিফলন দুর্নিবার। তৎকালীন সামরিক কর্তাব্যক্তিরা অবশ্য এই উপন্যাসকে রেহাই দেয়নি, শহরের মাঝখানে তূপাকৃতি করে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। যাই হোক, এই আত্মজৈবনিক উপন্যাসের প্রতিটি পরিচ্ছেদ এতটাই সচেতনভাবে সাজানো যে প্রধান এক চরিত্রের প্রকৃত পরিচয় শেষতক গোপন রেখেছিলেন লেখক। আশা করি বাংলায় অনূদিত এই বইয়ের নিবিড়পাঠ পাঠকের ভালোলাগার সাথে সাথে তাকে ভিন্নতর অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করবে।
পরিশেষে একটু ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করলেই নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক, শ্রদ্ধাভাজন এম এম আকাশ বইটির সঙ্গে আমার প্রাথমিক পরিচয় না ঘটিয়ে দিলে আমি এমন একটি চমৎকার, হৃদয়গ্রাহী উপন্যাস অনুবাদ করার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতাম। আর-একজনের কথা না উল্লেখ করলেই নয়। কর্ম উপলক্ষে স্বল্পকালের জন্য বাংলাদেশে আসা যুক্তরাষ্ট্রের এক ব্যক্তির কথা। নাম তার জেনিফার লরেঞ্জ। তিনি আমাকে মূল ইংরেজির কিছু কিছু আঞ্চলিক শব্দ, অভিব্যক্তি এবং বাগ্-বৈশিষ্ট্য বুঝতে সাগ্রহে সাহায্য করেছেন।
আমি ওই বয়সেই চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম আমি ছেলেটিকে ধরবাে অথবা ধরবার জন্য লােকজনের সাহায্য চাইবাে, সবাই আমাকে ভিড় করে দেখবে, আমার শরীরের বাঁক দেখবে, উজ্জ্বলতা দেখবে, যন্ত্রণা দেখবে, আমার আর্তস্বর, আমার ক্রোধ, আমার কান্না দেখবে। কেউ আহা উহু করবে, কেউ গায়ে পড়ে জানতে চাইবে ব্যাপারটি কী, কেউ ছেলেটিকে ধরে এনে কষে দুই থাপ্পড় মারবার কথা বলবে, কেউ বাড়ি কোথায়, বাবা কে ইত্যাদির খোঁজখবর নেবে। আসলে সবাই তারা আমাকে উপভােগ করবে। আমার অসহায়ত্ব উপভােগ করবে। আমার নিরাপত্তাহীনতা উপভােগ করবে। পােড়া বাহু দেখবার নাম করে আসলে তারা আমার সুডােল খােলা বাহুটিই দেখবে। আমি চলে গেলে পেছনের শুভার্থীরা সমস্বরে সিটি দেবে। এসব ভেবেই আমি আমার সমস্ত যন্ত্রণা নিজের ভেতরে চেপে রেখেছিলাম।