প্রকাশিত হলো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ কবিতা সমগ্র্র’র প্রথম খণ্ড , যার মধ্যে গ্রথিত হয়েছে তার ছ’টি কাব্যগ্রন্থ ; ‘একা এবং কয়েকজন’, ‘আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি’, ‘বন্দী , জেগে আছো’, ‘আমার স্বপ্ন’, ‘সত্যবদ্ধ অভিমান’, ও ‘জাগরন হেমবর্ণ’। বাংলা কবিতার যারা প্রেমিক পাঠক , তাদের কাছে এ এক মস্ত খবর সন্দেহ নেই। কেননা ,বাংলা কথাসাহিত্যের সেরা একজন লেখক যিনি, সেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যে বাংলা কবিতারও এক অতিশক্তিমান স্রষ্টা , তা কে না জানে। এই কথাটাও সবাই জানে না যে, পঞ্চাশের শতকে ‘কৃত্তিবাস’ নামক যে আন্দোলন একদিন বাংলা কবিতার মোড় একেবারে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল , সুনীলই ছিল তার নেতৃস্থানীয় কবি। পাঠক , সমালোচক সবাই সেদিন অবাক মেনে নিয়েছিলেন। সবাই লক্ষ্য করেছিলেন যে ,এই কবি কোনও পুরনো কথা শুনাচ্ছেন না। তিনি যা কিছু লিখছেণ তারই ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে এক ঝলক টাটকা বাতাস। আর সেই বাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছে এমন এক সৌরভ, যা তার আগে পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
বারান্দার নীচে বাগানে বসে আমরা চা খাচ্ছিলাম: আমি, আমার স্ত্রী মনােবীণা, মেয়ে অমলা। নাতনিটি বাগানে ছােটাছুটি করে খেলা করছে, পাতা ছিড়ছে গাছের, ফটকের কাছে শিউলি গাছটার তলায় গিয়ে ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে আছে, বােধ হয় কুঁড়ি দেখছে, তাকে বলা হয়েছে সন্ধের পর ফুল ফুটতে শুরু করবে, হয়তাে সেই আশায় অপেক্ষা করছে। বেতের হালকা গােল টেবিল, চার-পাঁচটা বেতেরই সস্তা চেয়ার, আমরা প্রায় টেবিল ঘিরে বসে আছি। বীণা নাতনির দিকে মুখ করে, অমলা আমার দিকে, আর আমি খানিকটা বেঁকা হয়ে পশ্চিমের দিকে মুখ করে বসে ছিলাম। বেতের টেবিলের ওপর চায়ের কাপ, বিস্কিট আর কুচো নিমকির প্লেট, মণি-মানে আমার নাতনির দুধের কাপ, ওভালটিনের শিশি। শরৎকালের শেষ, বিকেল নেই, সন্ধেও হয়নি পুরােপুরি, মাঝামাঝি অবস্থা, ঝাপসা গাঢ় হয়ে আসছে, সামান্য পরেই অন্ধকার নামবে।
সঙ্গে সঙ্গে আজকালকার কবিতার আর একটা বিশেষত্ব নজরে পড়ে। সেটা হচ্ছে কোনাে কবিতা সমগ্রভাবে হয়তাে মনে কিছু দাগ কাটে, কিন্তু কোনাে বিশেষ পক্তি কিংবা কোনাে বিশেষ ছবি সব সময় মনে থাকে না। অর্থাৎ আবেগ দু একটা ছবিতে কিংবা দু একটা লাইনে দানা না বেঁধে সমস্ত লেখায় শিথিলভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক সময় উচ্ছাসে মিলিয়ে যায়। কবি শক্তিমান হলে এই বিস্তারের ফল যে শুভ হয় সেটা নিঃসন্দেহ। কিন্তু কবিদেরও বিচ্যুতি হয় বারে বারে; অনেক সময় বিলম্বিত লয়ে বিস্তারটা আবেগ-প্রসূত না হয়ে ছন্দের ও অভ্যাসের ঠেলায় হয়। এবং যেহেতু দশটা কবিতা লিখলে বড় জোর হয়তাে একটা উৎরােয়, সেহেতু পাঠকদের বিড়ম্বনার সম্ভাবনা আজকাল অনেক বেশি।
অবনীন্দ্রনাথ গভর্ণমেণ্ট আর্ট স্কুলের চাকরি ছেড়েছেন, ঝগড়া করেই ছেড়ে দিয়েছেন, প্রায় বছর ছয়েক হল। বাড়িতে বসে দিব্যি ঝাড়া-হাত-পা হয়ে মনের আনন্দে ছবি আঁকছেন, পড়াশুনা করছেন, বেশ আছেন—তিনি কি স্বইচ্ছায় চাকরির ফাঁদে আবার পা গলান ? তাই আশুতােষের প্রতিনিধিরূপে যাঁরাই অবনীন্দ্রনাথের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের সকলকেই তিনি হাঁকিয়ে দিয়েছেন, শ্রীদিনেশচন্দ্র সেনকে সুদ্ধ। এইবার স্বয়ং আশুতােষের পালা ।
সাইকেল রিকশায় উঠতে গিয়ে ফ্যাঁস করে শাড়ি ছিড়ে গেল বিশাখার। বেশ অনেকটা। সঙ্গে সঙ্গে বিশাখার বুকে এমন একটা কষ্টের অনুভব হল, অনেক মূল্যবান কিছু হারালেও ততটা হয় না। প্রত্যেক শাড়িরই দু’রকম আয়ু থাকে, প্রথম হল পছন্দের আয়ু, দ্বিতীয় হল তার টিকে থাকার আয়ু। আচমকা এভাবে ছিড়ে গেলে সেটা যেন অপমৃত্যু। কোনও প্রিয়জনের বিমান দুর্ঘটনার মতন।