ডাহা মিছে কথা লিখেছে স্যর। সব মনগড়াননা কথা। ওরা আমার আসল পেশা জানে না। আসল কথা, জয়শঙ্কর বাজপেয়ীকে পুলিশ একেবারেই সুনজরে দেখতে পারে না। তাই এই সব আজে বাজে কথা আমার নামে লিখেছে। আপনি ওদের রিপাের্ট একটুও বিশ্বাস করবেন না। ওরা তিলকে তাল করে। আমার আসল ব্যবসা হল এক্সপাের্ট-ইমপাের্ট। আপনিই বলুন না স্যর, যখন ' জিনিস আমদানি করি এবং সেই জিনিস যদি কাস্টমসের কর্তাদের চোখে না পড়ে তবে দোষটা কী আমার? কাস্টমস যে কাজে ফাকি দিচ্ছে এই কথাটি কেউ বলবে না। সবাই আমাকে দুষবে, বলবে, জয়শঙ্কর বাজপেয়ী স্মাগলার।
একদিকে চন্দন রঙের পদ্ম, আর একদিকে কালীয়নাগের মতাে মেঘনা। চন্দনা পদ্ম | মেঘবতী মেঘনার জলে একটা উচ্ছল গানের কলির মতােই ভেঙে পড়ে। উত্তাল ঢেউয়ে ঢেউয়ে টলমল করে ডিঙি-ডােঙা, শালতি-মাল্লাই, হাজারমণি মহাজনী নৌকো। ব্যাপারীদের ভাউলে আসে উত্তর দিগন্ত থেকে। খেকরি আখ, রসগুড়, সবরী আম, এমনি নানান জিনিসের চালান নিয়ে। যাযাবার পাখির মত পালের পাখনা মেলে অদৃশ্য হয়ে যায় কেরায়া নৌকোর মিছিল, ‘গয়নার নাও’-এর সারি।
গত বছর পুরাে একটি মাস টান টান উত্তেজনার পর হজরতবাল মসজিদে আটক সশস্ত্র কাশ্মীরি জঙ্গিরা আত্মসমর্পণ করল। টিভির পর্দায় সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে আবিদ হােসেন আর গােলাম রসুলের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ওদের প্রসঙ্গ শুরু করার আগে ছােট্ট একটি ভূমিকা আছে। উনিশ শ’ পঁচাত্তর বা ছিয়াত্তরে আমাকে কাশ্মীর যেতে হয়েছিল। বম্বের এক ফিল্ম কোম্পানি বিদেশি গল্প বেমালুম চুরি করে তখন একটা ক্রাইম থ্রিলার জাতীয় ছবি তৈরির ছক পাকা করে ফেলেছে। কাশ্মীরের ব্যাকগ্রাউন্ডে বাংলা-হিন্দি দ্বিভাষিক ছবি। প্রােডিউসারের একটি লোেক, নাম সুরেশ বেরি, কলকাতায় এসে বললে, আমাকে লােকেশানে গিয়ে বাংলা সংলাপগুলাে লিখে দিতে হবে।
ছুটির দিনের এই দুপুরবেলায় রাস্তায় লােকজন খুব কম। গাড়ি টাড়িও বিশেষ চোখে পড়ে না। যা দু-একটা দেখা যাচ্ছে সেগুলাের সারা গায়ে আলস্য মাখানাে। যেন কোথাও যাবার তাড়া নেই তাদের; গড়িমসি করতে করতে এগিয়ে চলেছে। নভেম্বর মাস শেষ হয়ে এল। কলকাতা মেট্রোপলিসের ওপর দিয়ে কনকনে উত্তুরে হাওয়া ঘােড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে। আকাশ একেবারে পরিষ্কার ; কোথাও মেঘের চিহ্ন নেই। সূর্য সরাসরি মাথার ওপরে উঠে এসেছে। শীতের ঠাণ্ডা সােনালি আলােয় ঝলমল করছে চারিদিক।
ছড়ানাে কমপাউন্ডের মধ্যিখানে বিশাল তেতলা বাড়িটার আগাপাশতলা সেকেলে অর্কিটেকচারের ছাপ। পুরু পুরু ছত্রিশ ইঞ্চি দেওয়াল। সেগুন কাঠের চওড়া চওড়া, মজবুত দরজা। জানালায় দু’টো করে পাল্লা। সেগুলাের একটায় খড়খড়ি, অন্যটায় রঙিন কাচ বসানাে। উঁচু উঁচু সিলিংয়ে পঙ্খের কাজ। বাড়িটার সামনে এবং পেছনের ফাঁকা জায়গায় একসময় খুব যত্ন করে বাগান করা হয়েছিল। দামি দামি, দুর্লভ গাছ কবেই হেজেমজে গেছে।
আমি জন্ম নিয়েছিলম সেকেলে কলকাতায়। শহরে শ্যাকড়া-গাড়ি ছটছে তখন ছড়ছড় করে ধলাে উড়িয়ে, দড়ির চাবুক পড়ছে হাড়-বের করা ঘােড়ার পিঠে। ছিল ট্রাম, না ছিল বাস, না ছিল মােটরগাড়ি।... বাবরা আপিসে যেতেন কষে তামাক টেনে নিয়ে। পান চিবােতে চিবােতে,
আদালতের সমন কিংবা পুলিশের পরােয়ানা থেকে যদিওবা ছাড় পাওয়া যায়, হিমালয়ের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করা যায় না। আর তা যায় না বলেই আজ আমি হিমালয়ে। সত্যি বলতে কি এবারে আমার হিমালয়ে আসার কোন কথাই ছিল না, পর্বতাভিযান তাে দূরের কথা। থাকবে কেমন করে? আমার এক ফরাসি বােন ভারত দর্শনে এসেছিল। তাকে নিয়ে প্রায় মাসখানেক দক্ষিণ-ভারত ভ্রমণ করেছি। তারপরে বম্বে গিয়ে তাকে বিমানে তুলে দিয়ে সবে দিনদশেক আগে কলকাতায় ফিরেছি। সুতরাং আমার এবছরের ভ্রমণ হয়ে গিয়েছে। বছরে একবারের বেশি বড়-ভ্রমণ হয়ে উঠে না।
“জঙ্গল-মহল” একেবারে মন-মৌজী লেখা। কোনাে মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে নয়। বনে-পাহাড়ে বন্দুক কাঁধে, বিচিত্র ও বিভিন্ন লােকের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানাের যে আনন্দ, সেই আনন্দই বিকিরণের চেষ্টা করেছি মাত্র। এই সংকলনের পাঠক-পাঠিকারা যদি সামান্যতম আনন্দও পান, তবেই জান আমার অরণ্য-বিলাস অসার্থক হয়নি। শ্রীমতী ঋতুর সানন্দ সম্মতি না থাকলে লেখার মত অন্তর্মুখী শখ অংকুরেই বিনষ্ট হত। রুজি রােজগারের পর যে অতি সামান্য সময় উদ্ধৃত্ত থাকে তার একটা বড় অংশ লেখার শখে নির্বিবাদে ব্যয় করতে দেওয়ায় আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। তাছাড়া এই বই প্রকাশ করেছেন তিনিই।
এমন আকাশ হবে তােমার চোখের মতাে ভাষাহীন নির্বাক পাথর, দৃষ্টি তার স্থির হবে মৃতের প্রাণের মতাে উদাসীন নির্মম শীতল, তুমি আছাে সর্বময় রাত্রির গহনে মিশে –আমি এক ক্লান্তির কফিনে, তুমি যদি মৃত্যু আনাে অবসাদে মূক আর কঠিন কুটিল রাত্রি জুড়ে হে আমার তমস্বিনী মর্মরিত রাত্ৰিময় মালা, মৃত্যুফুলে বেদনার প্রাণদাহী ফুলে ফুলে হে আমার উদাসীন মালা, আমার জীবন তুমি জর্জরিত করাে এই দিনে রাত্রে দুপুরে বিকেলে এবং আমাকে বলাে,