যাহাকে অন্ধকার মধ্যে আলাে বলিয়া জানিত—অন্য আপন কেহ না থাকা সত্ত্বেও যে ভাইটিকে পাইয়া তাহার আর অভাব মনে হইত না—যাহাকে সে প্রাণ অপেক্ষাও ভালবাসে, সে তাহার ভাই নয়। সে তাহার কেহই নয়। তাহার সহিত কোন সম্পর্কই নাই। সে ভালবাসাতেও তাহার অধিকার নাই। এ সংসারে মালতী অনাথা বালিকা, রমেশের ন্যায্য স্নেহের সামগ্রী নহে, তাহাতে তাহার জোর নাই, তাহার কৃপা-ভাজন আশ্রিত মাত্র। হয়তাে এই সকল কারণেই তাহার হৃদয় ব্যথিত হইল, কিন্তু এত কথা তাহার মনে আসে নাই; কেন যে তাহার কষ্ট, কষ্টের কথা রমেশ কি বলিলেন, সে তাহা বুঝিল না, অথচ অকারণে কি একটি মর্মভেদী তীব্র-যাতনায় তাহার হৃদয় আলােড়িত হইয়া উঠিল।
অমৃতসর মেলে আপাতত তাদের গন্তব্য লখনউ। সেখানে কয়েকদিন বিরতি দিয়ে অতঃপর তারা পাড়ি দেবে মহান হিমালয়ের গহন গভীরে, ঘুরে বেড়াবে লক্ষ্যহীন, উদ্দেশ্যহীন, আবিষ্কার করবে স্বর্গীয় সুষমায় আপ্লত বরফে-ঢাকা অজস্র সব পর্বতশৃঙ্গ, ওতপ্রােত হয়ে থাকবে চমক দেওয়া বিচিত্র পাহাড়ি-পথ আর সার সার দেশলাই বাক্সের মতাে পাহাড়ের গায়ে সেঁটে থাকা অচিন লােকালয় আর দোকানপার্টের রহস্য উন্মােচনে, তারপর ফিরে এসে কলকাতার জটিল যন্ত্রণায় পুনর্বার ডুব দেবে পাহাড়ের জীবনযাপনের স্মৃতিতে রােমস্থিত হতে হতে। ট্যুর প্রােগ্রামটা এ ভাবেই ছকেছে সায়ন, অনেকদিন ধরেই বলছিল, চলাে গার্গী, ভীষণ এজস্টেড লাগছে, এখন কিছুদিন হিমালয়ের নিভৃত কোনও আস্তানা ছাড়া পরিত্রাণ নেই।
বৃষ্টি পতনের শব্দ গাছপালার মধ্যে একরকম, টিনের চালে একরকম। আর পুকুরের জলে একেবারে আলাদা। এই শব্দের মধ্যে আদিনাথের উচ্চারিত মন্ত্র তাঁর অভীষ্ট দেবতারা কীভাবে শুনতে পাবেন কে জানে? এখন বরুণদেবেরই একচ্ছত্র অধিষ্ঠান। কিন্তু তাঁর নামে কোনও শ্লোক এখানকার কারও জানা নেই। দেবতারা বহু দূরে থাকেন, সেইজন্যই বােধহয় আদিনাথ মন্ত্রোচ্চারণ করেন খুব জোরে জোরে। অথবা তিনি নিজের কণ্ঠস্বর শুনতে ভালবাসেন।
এই মৌলিক প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে গেলে আর একটি অস্বস্তিকর সত্যের সম্মুখীন হতে হবে আমাদের সাহিত্যের অন্যান্য অনেক শাখার ক্ষেত্রে যে সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা আমরা গ্রহণ করেছি, উপন্যাসের বেলায় সেই অব্যর্থ ও স্বীকৃত কোনাে সংজ্ঞা এখনও গড়ে ওঠেনি। এই সত্য কেবলমাত্র বাংলা উপন্যাসের সম্বন্ধে প্রযােজ্য হলে অস্বস্তির মাত্রা হ্রাস পেত, কারণ বাংলা উপন্যাসের সমালােচনা বােধহয় এখনও প্রাথমিক পর্যায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। কিন্তু ইংরেজি উপন্যাসের আলােচনা সম্পর্কে সে কথা বলা চলে না—এই সব আলােচনায় বিভিন্ন দিক থেকে উপন্যাসের বিশ্লেষণ আমাদের চোখে পড়ে। অথচ, এ বিষয়ে উল্লেখযােগ্য গ্রন্থগুলিও উপন্যাসের স্থিরীকৃত কোনাে সংজ্ঞা ও মানদন্ডে উপস্থিত হতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
নাটমণ্ডপের মেঝেটা বাঁধানাে হলেও ছাদ পাকা নয়। টিনের চাল। চালের তলায় চটের সিলিং, এখানে সেখানে চালের ফুটো দিয়ে জল পড়ছে। বাইরে সরু দাগের বৃষ্টি এখন মােটা দাগে পড়ছে। আর একটু বাড়লে মুষলধারা। ঠিক বাগান নয়, তবে কালীবাড়ির ঘেরা জমিতে গাছপালা বড় কম নেই। তারই একটার দিকে চেয়ে ছিল গৌরাঙ্গ। দেড় মানুষ উঁচু টগর গাছ। তাতে হাঁদার মতাে দাঁত বের করে অজস্র টগর ফুল ফুটে আছে। এই ফুটে থাকার কোনও মানে হয়? একেই তাে ফালতু ফুল, তার ওপর কেরামতি দেখাতে ফুটেছে হাজারে বিজারে। ফোট শালারা।