ইস্কুল-জীবন থেকে গল্প লেখার কলম হাতে নিয়ে কতই না কল্পনার জাল বুনে চলেছি। যতদূর মনে পড়ে, সাহিত্য লেখার খামখেয়ালিপনা শুরু হয়েছিল আমার একটি কবিতা দিয়ে। খুব অল্পবয়সে সেটি প্রকাশিত হয়েছিল মাসপয়লা’ নামের একটি শিশু-কিশাের পত্রিকায়। পত্রিকাটি এখন লুপ্ত। যে-সময়ের কথা বলছি, তখন ছােটদের জন্য নিয়মিত অনেক গুলি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হত। যেমন: শিশুসাথী, মৌচাক, রংমশাল, রামধনু, ভাই-বোেন, মাসপয়লা প্রভৃতি। এখন কোনওটিই আর চোখে পড়ে না। এইসব পত্রিকায় সেইসময়ের কত প্রখ্যাত লেখকের প্রকাশিত গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ আমাদের মন ভরিয়ে দিত। তখন সাময়িক ভাবে প্রকাশ বন্ধ ছিল সন্দেশ’-এর। সেই কারণে শৈশবে সন্দেশের স্বাদ আমরা পাইনি।
মােম্বাসা থেকে নাইরােবি যেতে হলে উগান্ডা রেলপথ ধরেই যেতে হবে। পৃথিবীতে এত সুন্দর রেলপথ সম্ভবত দ্বিতীয় আর নেই। আর সেই রেলযাত্রা ব্রিটিশ ইস্ট আফ্রিকাতে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক অভিজ্ঞতা বললেও কিছু অত্যুক্তি হবে না। সাগর থেকে যাত্রা করে সুবিস্তৃত ভূখণ্ড পেরিয়ে এই রেলপথ গিয়ে শেষ হয়েছে ভিক্টোরিয়া নিয়ানঞ্জাতে। শুরুতে শহর মােম্বাসা; তিনশাে তিরিশ মাইল দূরের শেষ শহর হল নাইরােণি। মাঝে মাঝে ঢেউ খেলানাে টিনের ঘর ঘিরে কয়েকটা কুটির। এইগুলােই হল রেল থামবার স্টেশন। ভবিষ্যতে যেগুলাের বিরাট বড় বড় শহর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দায়রা জজ ফাঁসির হুকুম দিলে আসামি শফিউজ্জামানের একজন কালাে আর একজন শাদা মানুষকে মনে পড়ে গিয়েছিল। এদেশের গ্রামাঞ্চলে শিশুরা চারদিকে অসংখ্য কালাে মানুষ দেখতে-দেখতে বড় হয় এবং নিজেরাও কালাে হতে থাকে। কিন্তু শাদা মানুষ, যার নােম ভুরু ও চুলও প্রচণ্ড শাদা, ভীষণ চমকে দেয়। . এর আগে শফিউজ্জামান ‘বিপজ্জনক ব্যক্তি’ ঘােষিত হন। একবার তাকে সাত বছরের জন্য জেলা থেকে নির্বাসিত করা হয়। ইংরেজের আইন একেক সময়ে ভারি অদ্ভুত, চেহারা নিত।
আমাদের মফস্বল শহরে বরাবরই খুব শীত পড়ত। একেই তাে জায়গাটা ছিল বিহারের পাহাড়ি এলাকা, তার ওপর আমাদের শহরের আশেপাশে ছিল যত রকম বনজঙ্গল। ছােটনাগপুর পার্বত্য এলাকা বলতে ভূগােল বইয়ে যা বােঝাত আমরা তার চেয়েও বেশি বুঝতাম, অন্তত শীতকালে পার্বত্য এলাকার দৌরাত্মটা বেশ হাড়ে হাড়ে অনুভব করতাম। তবু একথা ঠিক, আমাদের মফস্বল শহরটি ছিল খুব সুন্দর।
মানুষ তার মনের ভাব যতই গােপন করার চেষ্টা করুক না কেন, তার বাইরের ছােটখাটো হাবভাব থেকেই সেটা ধরা পড়ে যায়। কথাটা যখন তােকে বললাম, ঠিক সেই সময়টা তাের একটা হাই। আসছিল। কিন্তু কথাটা শুনে মুখটা খানিকটা খুলেই বন্ধ হয়ে গেল। তুই যদি আমার কথায় উত্তেজিত না হতিস, তা হলে কিন্তু যথারীতি হাইটা তুলতিস—মাঝপথে থেমে যেতিস না।
টমটমপুর নামে কোনাে জায়গা কোথাও নেই। টমটমপুর নামে কোনাে জায়গা কোথাও ছিলাে না। আসলে অন্য একটা জায়গার কথা কিছুদিন হলাে বারবার লিখছি, এবার তাই নামটা একটু বদলিয়ে দিলাম। তবে এই নাম বদলের অন্য একটা কারণও আছে। যানবাহন বলতে নৌকো ছাড়া টমটম ঘােড়ার গাড়িই ছিলাে আমাদের অল্পবয়সের সেই শহরের একমাত্র সম্বল। হয়তাে কারাে মনে পড়তে পারে ডুলি বা পালকিও ছিলাে, কিন্তু তার ব্যবহার ছিলাে সীমিত, সংখ্যা ছিল নিতান্তই নগণ্য। অবশ্য যাতায়াত প্রধানত ছিলাে জলপথেই, স্থলপথ প্রায় ছিলাে না বললেই চলে। রেলগাড়ি আমরা ছােটবেলায় চোখেই দেখিনি।
যাই হােক, এ্যামে তুলে নকুড় মামাকে নিয়ে যাই ঠেলে ঠেলে। প্রদর্শনীর গেট। পেরিয়ে যতই এগুচ্ছি ততই ভিড় জমে যাচ্ছে নকুড় মামাকে দেখতে। মামার ধৈর্য। অসাধারণ। তিনি নাকের নীচে অবধি চাদর ঢাকা দিয়ে রেখেছেন। মুখে বাক্য নেই। কিন্তু কতক্ষণ আর ধৈর্য ধরবেন, বিচারকের বিরুদ্ধে একবার রুখে উঠলেন আর গাড়ির ওপর দাঁড়িয়ে উঠেই ওজস্বিনী ভাষায় বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করলেন। গোঁফের কথা তখন আর মনে ছিল না। আর তাই না দেখে কী হাসি সবার! এক বছরের বাচ্চারাও হেসে উঠলাে।
রহস্য গল্পের গোলকধাঁধার পাঠক নিজেকে জড়িয়ে ফেলে খুঁজতে থাকেন। রহস্যভেদের জটিল পথ। আর গল্পের রহস্য পাঠককে টেনে নিয়ে যায় রুদ্ধশ্বাস শেষ লাইনের দিকে রহস্য সমাধানের লোভ দেখিয়ে। এই টানটান উত্তেজনাটুকুই রহস্য গল্পের প্রাণভোমরা। যে-রহস্য গল্পের সমাধান-ইঙ্গিত পাঠকের মন নিয়ে লুকোচুরি খেলে, ধরা দিয়ে আবারও অধরার দিকে হাতছানি দিতে-দিতে পাঠক-মনকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আড়ালে থেকে ধরা দেয়, সেই গল্পই জয় করে পাঠকের মন। আমরা পঁচিশটি জমজমাট রহস্য গল্পের এই সংকলনের আয়োজন করেছি, পাঠকরা মাথা খাটিয়ে রহস্যের কিনারা করতে উৎসাহী হবেন, গল্পের রহস্যের সমাধানের সঙ্গে নিজেদের বুদ্ধিদীপ্ত সমাধানকে একলহমায় মিলিয়ে দেবেন অনাযাসে, এই আশায়। সব শেষে পাঠক যদি ভাবতে পারেন ‘আমিই রহস্যভেদী’, তাহলেই আমাদের পরিকল্পনা সার্থক।
‘ভূত নেই’ আর ‘ভুত আছে’_এই দুই বিশ্বাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভূতকে বাঁচিয়ে রেখেছে মানুষ। পৃথিবী জুড়ে ভূতকে নিয়ে ঘটে গেছে নানা কাণ্ডকারখানা। লেখা হয়েছে অসংখ্য বই। তৈরি হয়েছে গা-ছমছমে অজস্র সিনেমা। আঁকা হয়েছে নানান বিখ্যাত ছবি। শিশু-কিশোর পাঠকরা যখন পুরোনো ভূতের গল্প পড়তে পড়তে এক্কেবারে ক্লান্ত, তখন আমরা ঠিক করেছিলাম এবার তাদের উপহার দেব নতুন ভূতের গল্প। সেরকমই ২৫টি গা-ছমছমে ভূতের গল্প নিয়ে এই অভিনব সংকলনগ্রন্থের পরিকল্পনা। নতুন ভূতের গল্প লিখে দিতে প্রতিষ্ঠিত লেখকরা প্রায় সবাই আমাদের জন্য কলম ধরেছেন আর সম্পাদনায় স্বয়ং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। ভূমিকায় তিনি জানিয়েছেন, ভূত আছে কি নেই_এই সনাতন প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে তিনিও লিখেছেন, কত নেই জিনিস নিয়েই তো গল্প লেখা হয়। আমরাও তাঁর সঙ্গে একমত। তাই ভূত নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে চলতে থাকুক ধুন্ধুমার সব কাণ্ড। আর সেই ফাঁকে আমাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে যাক এইসব নতুন ভূতেদের। চলো, আমরা চটপট পড়ে ফেলি এই ২৫টি নতুন ভূতের গল্প।
ইংরেজিতেই দুজনের কথা চলছিল। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছিল যুবকটি বাঙালি। আজকাল আর আগের মতাে বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের দেখে বাঙালি-অবাঙালি কিছু বােঝা যায় না। তাহলেও এ চোখ কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের। আমি আরও এক পা এগিয়ে তার কাঁধে হাত রাখলুম। সে দ্রুত, যেন, অপ্রত্যাশিত গায়ে-পড়া অন্তরঙ্গতায় খাপ্পা হয়েই ঘুরে দাঁড়াল আমার মুখােমুখি। আমিও দ্রুত বলে উঠলুম, হােয়াট হ্যাপ, ইয়ং ম্যান? কী ঘটেছে? আস্তে কাঁধ থেকে আমার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল, নাথিং!
গাড়ির চাকা এতক্ষণে গড়াল। নীপার মনে হল, স্টার্ট দিয়ে থেমে বীতশােক কী যেন ভাবছিল। গাড়িটা পুরনাে মডেলের অ্যাম্বাসাডর। কিন্তু পৌরাণিক বীরদের মতাে স্থিতধী এবং দার্শনিকও। নীপার এইরকম মনে হয়। সে সােমনাথের আঁতলামিকে ব্যঙ্গ করে। অথচ কোনও-কোনও সময়ে সে নিজের চিন্তায় আঁতলামি লক্ষ্য করে।
হােটেল দ্য লেক ভিউ-এর ব্যালকনি থেকে বাইনােকুলারে সেই সেক্রেটারি বার্ডটিকে খুঁজছিলাম। সারস জাতীয় এই দুর্লভ পাখিকে বাংলায় বলা হয় কেরানি পাখি। কারণ, সহসা দেখলে মনে হয়, তার কানে যেন কলম গোঁজা আছে। কাল বিকেলে হ্রদের তীর থেকে পাখিটাকে কয়েক মুহুর্তের জন্য দেখেছিলাম। বিস্তীর্ণ এই প্রাকৃতিক জলাশয়ের মধ্যিখানে একটা জলটঙ্গি আছে। সেখানে ঘন জঙ্গল। পাখিটা একলা, নাকি তার সঙ্গী বা সঙ্গিনী আছে জানি না। তবে সে অতিশয় ধূর্ত তাতে কোন সন্দেহ নেই। এমন একটা দুর্গম জঙ্গলে সে তার ডেরা বেছে নিয়েছে।
চমৎকার একটা বই এসে গেল হাতে। শ-র আলমারী ভেঙে আনা। কথা দিয়েছি পড়া হলেই তৎমুহূর্তে ফেরত। কিন্তু আসল ফ্যালাসিটা ওখানেই। পড়া হলে। পড়া যদি এ জীবনে শেষ না হয় ? আমি সারা জীবনে কোনাে বই শেষ পর্যন্ত পড়তে পারিনি। পড়তে পড়তে, খারাপ লাগলে তাে অন্য কথা, ছুড়েই ফেলে দি। ভালােলাগা বই-এর কথাই বলছি শুধু। পড়তে পড়তে হঠাৎ আলাের ঝলকানির মতাে কিছু একটা যেই ঘটে যায় বুকের মধ্যে কিংবা বুকের ভিতরটায় গমগমিয়ে ওঠে লম্বা ব্রীজের উপর ট্রেনের শব্দের। মতাে কোনাে দুর্দান্ত অনুভব, আমি সে বই আর পড়ি না, অন্তত তখনকার মত। তখন হয়ে যাই গৃহপালিত গাভী।
কিটু লাহিড়ির আসল নাম কীর্তি লাহিড়ি। ওর ডাকনাম কিছু, কিন্তু বােধ হয় আধুনিক হবার ঝোঁকেই নিজের ডাকনামকেই স্থায়ী করে নিয়েছে। এই গােয়েন্দাটি একটু অন্য রকম। ওর যে গুরু ফটিকচাঁদ সে আরও অন্যরকম। এরই ডাকনাম বাঘা। একদিন জেল থেকে বেরিয়েই সম্পূর্ণ অপরিচিত এই ব্যক্তি হঠাৎই বাড়ির তালা খুলে ঢুকে পড়েন কিটু লাহিড়ির বাড়িতে। সেই থেকেই কিছুর কাজের-লােক, বন্ধু, সহকারি, অভিভাবক এবং মুখ্য উপদেষ্টা। বাঘাকাকা না হলে কিটু লাহিড়ির আর উপায় নেই। সমস্যার সমাধান অনেক সময়েই বাঘাকাকাই করে দেন, কিটু তাতে একটু-আধটু মন খারাপ করে, কিন্তু উপায়ই বা কি ? বাঘাকাকা জানেন অনেক কিছু মনে রাখার ক্ষমতা অসাধারণ, আর যা রান্না করেন তা খেয়ে রাজা মহারাজারাও অখুসি হবেন না !
তা, যেখানে নেই সেখানে যে কত কী রয়েছে, সেটা আমি বারেবারে বুঝেছি, এবার আমার জীবনের একটা ঘটনা বলি। আমার এক আত্মীয়র বাড়ি আসানসােলে। আমি সেখানে গেছি। তাদের দোতলা বাড়ি। দোতলায় কেউ থাকে না। সেই দোতলায় তারা একটা বড় ঘর খুলে দিলেন। দিয়ে বললেন, আপনি এখানে থাকবেন। সেই দোতলাটার আবার এমন কায়দা, একতলা থেকে সিঁড়ি উঠে দোতলায় যায়নি।