Categories


ফিসফাস -২

সেই যে সেই ৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩-তে মুখ দেখাল। তারপর রোলস রয়েসের গতিতে বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বেস্ট সেলার হয়ে গেল। পাঠক পাঠিকারা তো প্রশ্ন করে করে হেদিয়ে যাচ্ছেন, "আহা পরেরটা কবে হবে গা?" তাই এই হয়ে গেল, প্রকাশক আর লেখক চাপ খেয়ে এই বইটিকে প্রথমটির থেকেও উন্নত করার চেষ্টা করবেন, সে আর নতুন কথা কী? তা পাঠক পাঠিকারা, এই যে এতদিন ধরে মইটা ধরে আছেন, তাঁদের ধন্যবাদ দিয়ে-টিয়েই না হয় ছোলা গাছের উপরই বাড়ি বানাই। ভিতের কাজটা তো আপনাদের হাতে। যত পড়বেন, যত চর্চা করবেন, যত উপহার দেবেন, ততই ভিত শক্ত হবে এই ফিসফাস ২-এর।


ধনপতির সিংহলযাত্রা

পারলে গােধূলির এই রং গণ্ডুষে শুষে নিত ধনপতি। ওই কেশ-কালা ফিঙেটির মতাে দোল খেত কর্ণের মাথায়। পশ্চিমের কমলা সূর্যের মতাে দিনশেষে ডুবে যেত ভ্রমরার জলে। গিরিমাটিরঙে রাঙিয়ে দিত আকাশের কোল।

কিন্তু তাকে যেতে হবে সিংহল দেশে, নােনা পথে—রাজার নির্দেশ। যে-জন চন্দনে শিবের আরাধনা করে সে সপ্তদ্বীপা অবনীতে রাজা হয়, যে শ্রীহরির সামনে চমরি দুলিয়ে বন্দনা করে সে রথে চড়ে স্বর্গে যায়; কিন্তু এক তােলাও চন্দনকাষ্ঠ নেই রাজভাণ্ডারে, চমরি নেই একটিও। ভাণ্ডারীর প্রয়ােজন গজের জন্য লবঙ্গ, তুরঙ্গের সৈন্ধব লবণ, রাজরানিদের পান্না, নীলা, মানিক, প্রবাল, মােতি ও পলা, বামাদের শত্থালংকার, কুঙ্কুম, কস্তুরি ও গন্ধচুয়া এবং বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পাহাড়িয়া ভােটকম্বল। রাজভাণ্ডারী বলে, যত ঋণী সদাগর ছিল তারা সব এখন ধনী। গেহ থেকে এক পা ফেলার মতি নেই কারাে। শেষ দক্ষিণ পাটনে গিয়েছিল জয়পতি দত্ত, ধনপতির বাবা। ডিঙার পর ডিঙা ভরে এনেছিল নানা সামগ্রী। তারপর আর কোনাে সাধু ওমুখাে হয়নি, কোনাে সদাগর আসেনি ওদেশ হতে। ফলে গুয়ারও টান। রায়, কীসে সাজা হবে তাম্বুল, কী দিয়ে রাখবেন মান!

 


অনন্ত দ্রাঘিমা

বুননা পাড়ার মুড়ােতে ঝাকড়া অশােখ গাছের ছায়া। গেল বছর এখানে একটা সবজে রঙের টিউকল বসিয়েছে সরকার। তার আগে বেশির ভাগ বুননা পাড়ার লােকে জল খেত বুড়িগাঙের, যাদের ভাগ্য ভালাে তারা যেত গাঁয়ের বারােয়ারি কুয়গাটায় জল আনতে। দড়ি-বালতি সেখানে ধপাস করে ফেলে দিয়ে জল তােল। খ্যাচালের ঘটাং ঘটাং শব্দ, পেশির টানে জলভরা বালতি উঠবে উপরপানে, কষ্ট বলতে চরম কষ্ট। তবু দুর্গামণি যেত মাটির কলসী নিয়ে, লাইন দিয়ে জল আনত। পাড়ার বউ-ঝিউড়িদের টীকা-টিপ্পনী কানে আসত তার। ভালাে লাগত না পরনিন্দা পরচর্চা শুনতে। বেশি বয়সে মা-হওয়ার সুখ যেমন জ্বালাও কম নয়। দু-চার শব্দ কানে বােলতার হুল ঢােকায়। তা-ও নেই নেই করে দেখতে-দেখতে রঘুর বয়স ষােল ছাড়াল। চুনারাম সেবার কথায় কথায় বলছিল, আমাদের ঘরের রঘুটা তাে গায়ে-গতরে হয়েছে, এবার ওর বিয়ে-থা দিয়ে লেটা চুকিয়ে দাও।


হারবার্ট

জানালার কাছে অনেকক্ষণ ধরে ডানা ঘষে কিছু হল না দেখে আকাশ ফিকে হবার ভয়ে পরী এক সময় শেষরাতের মধ্যে দোকানে ফিরে গেল। টিকটিকি ও আরশােলারা পরীর দিকে আর মন দেয়নি। হারবার্টের ঘরে আটকে পড়া একটা মাছি রাত ১২টা নাগাদ হারবার্টের বাঁ হাতের শিরা কাটার সময়ে সমুদ্রের মধ্যে অন্ধ হাঙরের মতাে রক্তের গন্ধ পেয়েছিল। কিন্তু কানা বলে সে সেখানে পৌছতে পারেনি। ঘরে যখন একটু একটু করে আলাে ঢুকছে তখন সে উড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা একটি ব্লেডের ওপরে গিয়ে বসেছিল যায় গায়ে রক্ত

 


কলিকাতায় নবকুমার

উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে রোজগারের অন্বেষণে যুবক নবকুমার রওনা হল ‘কলিকতা’র দিকে। সঙ্গী যাত্রাজগতের এক মানুষ মাস্টারদা। চিৎপুরের কোনও যাত্ৰাদলে নবকুমারকে একটা কাজ জুটিয়ে দেবে। মাস্টারদা নবকুমারকে নিয়ে এল সোনাগাছিতে, তার পরিচিত পুরোনোদিনের যাত্রার নামী অভিনেত্রী ‘শেফালি-মা'র বাড়ি। কে জানে, মনের কোন রসায়নে শেফালি-মা-র ভালো লেগে গেল ছেলেটিকে। তারপর?...
সমরেশ মজুমদারের জাদুকলমে শুরু হল এক মেগাউপন্যাস। প্রতিমুহূর্তে সৎ, সত্যভাষী নবকুমারের মনে হতে থাকে এই শহরে সে বেমানান। লালবাতি’ এলাকার মেয়েদের জীবনযন্ত্রণা তাকে রক্তাক্ত করে। পাশাপাশি যাত্রার গদিতে প্ৰস্পটারের কাজে দক্ষতা তাকে ‘বড়বাবুর নজরে এনে দেয় | 
বহে চলে ঘটনাস্রোত। গ্রামের যুবকের চোখ দিয়ে ফুটে ওঠে সোনাগাছির দিন-রাত, হাসি-কান্না প্ৰেম-ঈর্ষা এবং চিৎপুরের যাত্ৰাদলের নানান টানাপোড়েন।
যাত্রার ‘বড়বাবু’ সিনেমার প্রযোজকও । নবকুমারকে তিনি পছন্দ করেন। পরবতী সিনেমার নায়ক হিসেবে। টালিগঞ্জের নতুন নায়ক হওয়ার অপ্রত্যাশিত সুযোগ। কিন্তু নবকুমার রাজি নয়। সে শুনেছে, সিনেমায় নামলে চরিত্র নষ্ট’ হয়ে যায়।..তারপর?.... নবকুমার কি শেষপর্যন্ত মানিয়ে নিতে পারল ‘কলিকতা’ শহরের সঙ্গে? সমরেশ বলছেন, “...বোধহয় পেরে গেল। “কলিকতা”। তার কাছে ‘কলকাতা’ হয়ে উঠেছে।...”


রাজনগর

কিন্তু তা হচ্ছে রানীর নিজের ইচ্ছায়, সুতরাং কেন কী জিজ্ঞাসা না করে যা হচ্ছে তা চোখে, যা হবে তা কল্পনায় দেখে নেয়া ভালাে। দেখার মতাে ব্যাপারও। দশ হাত উঁচু সেই হাওয়াঘরের ভিত আছে, চওড়া চওড়া সিঁড়িগুলাে আছে, মন্দির কিন্তু উঠছে নিচের মাটি থেকে, ইদারার মতাে গেঁথে তােলা। হাওয়াঘরের মেঝে থাকবে মন্দিরের চারিদিকে বারান্দা চত্বর হয়ে। সে চত্বরে উঠতে হবে পুরােনাে সিঁড়ি বেয়ে, অন্য নতুন সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে মন্দিরের গর্ভে পুজো দিতে। অখাদ্য-খাওয়া অনাচারী সেই আধা-ফরাসীর হাওয়াঘরের মেঝেতে মন্দির হয়?