যাত্রার আগে কয়েকটি তথ্য আমরা সংগ্রহ করে নিয়েছিলাম। বরপেটা রােডের বাজারে রাত্রির আহার সেরে পরের দিনের খাদ্য সংগ্রহ করে নিতে হবে। কেন না, তারপর মাইল পঁচিশেকের মধ্যে আর কোনও দোকান নেই। চেক পোেস্ট থেকে প্রায় মাইল পনেরাে দূরে ঘন অরণ্যের মধ্যে ডাক বাংলােতে খাদ্য ব্যবস্থা রাখা সম্ভব হয় না। তবে বাংলােতে আমার নামে একটা ঘর আগে থেকেই রিজার্ভ করা আছে, সে জন্য চৌকিদার আমাকে ফেরাবে না, এবং আমি সঙ্গে চাল ডাল নিয়ে গেলে সে রান্না করে দেবে। মানস অরণ্যে দর্শনাথী অধিকাংশই সাহেব হয়, তারা সঙ্গে টিনের কৌটোয় খাদ্য ও পাঁউরুটি নিয়ে যায়। ডাকবাংলােয় আলাে নেই, আমাদের মােমবাতিও নিতে হবে সঙ্গে করে। বরপেটা রােড বাজার পৌঁছবার আগেই নিকষ কালাে রাস্তায় জিপ গাড়িটা দুবার হেঁচকি তুলে থেমে গেল। আমি সচকিতে ওঝাকে জিগ্যেস করলাম, কী হল?
খুব ছােটবেলা থেকেই আমার ভ্রমণের নেশা। সব সময় মনে হতাে, এই পৃথিবীতে জন্মেছি, যতটা পারি তা দেখে যাবাে না? কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও পয়সা তাে ছিল না, তাই জমাননা কুড়ি-তিরিশ টাকা হাতে পেলেই চলে যেতাম কাছাকাছি কোথাও। এক সময় জাহাজের নাবিক হবারও স্বপ্ন ছিল আমার। তা অবশ্য হতে পারিনি। তবে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত গেছি কয়েকবার। দেশের মধ্যে সব কটি রাজ্যে, পশ্চিমবাংলার মধ্যেও সব কটি জেলা এবং মহকুমা, এমনকী অনেক গ্রামে গ্রামেও ঘুরেছি। কখনাে রাত কাটিয়েছি গাছতলায়, কখনাে নদীর বুকে নৌকোয়, কখনাে পাঁচতারা হােটেলে। এই সব ভ্রমণ নিয়ে লেখালেখিও করেছি অনেক। এখন দেখতে পাচ্ছি সেইসব লেখা জমে জমেও প্রায় পাহাড় হয়ে গেছে।
দেশীয় শিল্প-বাণিজ্যের অবনতি ও ক্রমবর্ধমান কৃষিজীবী শ্রেণি জমিদারের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে বেশ বাড়িয়ে দিয়েছিল। সহযােগী শ্রেণি হিসাবে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের নিকট জমিদারদের মর্যাদা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তাছাড়া ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছিল মেকলের ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণি, যারা ইউরােপীয় সভ্যতা ও জীবনধারা তামাম ভারতবাসীর নিকট যথার্থভাবে ব্যাখ্যা বা interpret করে তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের সমর্থক করে তুলবে। এই interpretor শ্রেণিও ছিল সাম্রাজ্যের স্থায়ীত্বের ভরসাস্থল।
লাইব্রেরি একটি জনহিতকর প্রতিষ্ঠান। এটি সমাজের সকল স্তরের সকল শ্রেণীর মানুষজনকে সেবা প্রদান করে। স্বাক্ষরতা থেকে শুরু করে শিক্ষা জগতের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত সর্বস্তরেই গ্রন্থাগার উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে। সমাজের সার্বিক উন্নয়নে গ্রন্থাগারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল এগুলি সবই সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে চিহ্নিত। এগুলি সমাজে বিভিন্নভাবে অবদান রাখে। তেমনি সমাজের প্রতি গ্রন্থাগারের অবদানের কথা স্মরণ করে এটিকেও সামাজিক প্রতিষ্ঠান বলা চলে।
জীবনে অনেক জিনিস ঘটে, যাহার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় —তাহাকে আমরা অতিপ্রাকৃত বলিয়া অভিহিত করি। জানি না, হয়তাে খুঁজিতে জানিলে তাহাদেরও সহজ ও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক কারণ বাহির করা যায়। মানুষের বিচার, বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতালব্ধ কারণগুলি ছাড়া অন্য কারণ হয়তাে তাহাদের থাকিতে পারে—ইহা লইয়া তর্ক উঠাইব না, শুধু এইটুকু বলিব, সেরূপ কারণ যদিও থাকে—আমাদের মতাে সাধারণ মানুষের দ্বারা তাহার আবিষ্কার হওয়া সম্ভব নয় বলিয়াই তাহাদিগকে অতিপ্রাকৃত বলা হয়।
পাড়াটায় ছ-সাত ঘর ব্রাত্মণের বাস মােটে। সকলের অবস্থাই খারাপ। পরস্পরকে ঠকিয়ে পরস্পরের কাছে ধার-ধাের করে এরা দিন গুজরান করে। অবিশ্যি কেউ কাউকে খুব ঠকাতে পারে না, কারণ সবাই বেশ হুঁশিয়ার। গরিব বলেই এরা বেশি কুচুটে ও হিংসুক, কেউ কারও ভাল দেখতে পারে না, বা কেউ কাউকে বিশ্বাসও করে না।
সকলের চেয়ে কাজ বাড়ে পূজো-আচ্চার দিনে—এ বাড়িতে বারাে মাসের বারােটা - পূর্ণিমাতে নিয়মিত ভাবে সত্যনারায়ণের সিন্নি হয়। গৃহদেবতা শালগ্রামের নিত্যপূজা তাে আছেই। তা ছাড়া লক্ষ্মীপূজা মাসে একটা লেগেই থাকে। এসব দিনে সংসারের দৈনিক বাসন বাদে পূজোর বাসন বেরােয় ঝুড়িখানেক। এঁদের সংসার অত্যন্ত সাত্ত্বিক গোঁড়া হিন্দুর সংসার পুজো-আচ্চার ব্যাপারে পান থেকে চুন খসবার জো নেই। সে ব্যাপারে দেখাশুননা করেন জ্যাঠাইমা স্বয়ং। ফলে ঠাকুরঘরের কাজ নিয়ে যাঁরা খাটাখাটুনি করেন, তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে।
তাকে খতম করার জন্য অর্থাৎ তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরি করার জন্য ওরা এখানে এসেছে। এই জেলাশাসকের কৃতকর্মের জন্য মেদিনীপুরের স্বাধীনচেতা দামাল ছেলেদের আদালতে, অনেক আগেই তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। সেটাও জানতে পেরে, প্রাণ বাঁচাতে অতি গােপনে রাতের অন্ধকারে বাংলা থেকে বদলি হয়ে, বিহারের মজফরপুর এসেছে। কাপুরুষরা জানে না যে, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিচারের শাস্তি ওকে পেতেই হবে। হাকিম নড়বে তাে হুকুম নড়বে না। তাই হুকুম বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে, প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম, মজফরপুর এসে, সবকিছু ঠিকঠাক মতাে দেখে নিচ্ছে। জেলাশাসক কিংসফোর্ড কোন্ রাস্তায় অফিসে যায় কখন যায়, কখন ফেরে। কোন গাড়িতে, কোন রাস্তায় যায়।
আমি রামগড় থেকে ঘুরতে ঘুরতে পুরুলিয়ার দিকে আসছিলাম। ধরে নাও চাস রােডেই কোথাও সেই বাংলােটা। আশেপাশে কোনাে শহর নেই—বাংলােটা বলতে গেলে জনশূন্য মাঠের মধ্যে। তখনও ওসব জায়গায় ইলেকট্রিক যায় নি। এখনও গেছে কিনা আমি জানি না। ডাকবাংলােটা নতুন তৈরি হয়েছে, বেশ ছিমছাম চেহারা। আমি সেখানেই সে রাতের জন্য বসতি নেবাে ঠিক করলুম।
উপেন্দ্র আর কোন প্রশ্ন না করিয়াই রাজী হইলেন। এটা তাহার অভ্যাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলি এতই ভাল করিয়া পাশ করিয়াছিলেন যে, ছাত্রমহলে তাহার শ্রদ্ধা ও সম্মানের অবধি ছিল না। ইহা তিনি জানিতেন। তাই, কাজে-কর্মে, আপদে-বিপদে তাহারা যখনই আসিয়া পড়িয়াছে, তাহাদের আবেদন ও উপবােধকে মমতায় কোনদিন উপেক্ষা করিয়া ফিরাইতে পারেন নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সরস্বতীকে ডিজাইয়া আদালতের লক্ষ্মীর সেবায় নিযুক্ত হইবার পরও ছেলেদের জিমন্যাস্টিকের আখড়া হইতে ফুটবল, ক্রিকেট ও ডিবেটিং ক্লাবের সেই উঁচু স্থানটিতে গিয়া পূর্বের মত তাহাকে বসিতে হইত।