ছড়িয়ে দেওয়া যায় না এমন আলোর দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছি। একেকটা স্বর আসে কাকেদের ডাকের মতো। রোমশ ঐ হাতের তলায় লুকোনো মার্বেল চোখের কোনায় অপেক্ষা লেখা ছিল। পাত্তা না দিয়ে গাঢ়তর আরও উপেক্ষার দিকে চলে গেছি। এখানে রাতের অভাব বোধ করতে হয়। দিন বড়ো একঘেয়ে আর ঘুণেরা অপ্রতিরোধ্য। খাটের পায়া থেকে সশরীরে উঠে আসা জীব এখন পুঞ্জীভূত ঘামের দিকে চলে যায়। পা গুলি ক্রমশ সরু হয়ে আসছে। টের পাই ও পাড়ার মেয়েরা জল নিতে এসে গল্পের সুবাদে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে। তাদের পুরুষ্ট নিতম্বের দুলুনিতে পা কাঁপে। আঁচল সরে গেলে পিঠের আঁচড়গুলি চওড়া হতে হতে একেকটা মেঘের মতো ফুটে থাকে। জলের আস্বাদ নিতে গিয়ে ঘাট পিছল হয় আরও। শ্যাওলার দেওয়ালটুকু বিবস্ত্র করে তিনতলা ছাত উঠে গেল... খালি পায়ে উঠে আসে একলা মেয়ে। তার বাম তিল স্পর্শ করে সতেজ হাওয়া শাড়ি উড়িয়ে নিতে সাহস পায় দিন দিন।
সােনালী মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলল, তােমার মাছ বেছে দিতে দিতে বড়মার খেতে অসুবিধে হয়। তুমি নামেও খােকন কাজেও খােকন। দ্যাখ সােনালী, আমি এ বাড়ির একমাত্র ছােট ছেলে। তুমি কখনও এ বাড়ির একমাত্র বড় ছেলে, আবার কখনও একমাত্র ছােট ছেলে। খােকনের মা হেসে উঠলেও খােকন ওর কথার কোনাে জবাব না দিয়ে আলু-পটলের তরকারি মাখা ভাত মুখে দিয়েই বলল, তরকারিটা লাভলি হয়েছে।
প্রবাদ আছে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধে হয়। আজকাল তাই আমি সন্ধেটা বাড়ির বাইরে কাটাতে চেষ্টা করছিলাম। সব দিন যে পারছিলাম এমন নয়। তবে কিছুদিন পারছিলাম। তিন বাড়িতে টিউশন, বইপাড়ায় প্রুফ দেখার পরও যেদিন দেখি সন্ধে কাটেনি সেদিন সােজা চলে যাচ্ছিলাম গঙ্গার ধারে, জাদুঘরের বারান্দায় অথবা চক্ররেলের স্টেশনে। এসব জায়গায় বসে সন্ধে হওয়া দেখতে চমৎকার লাগে। মনে হয় কে যেন আঁজলা করে খানিকটা অন্ধকার ভারি যত্নে ফেলছে কলকাতার ওপর! ভাবছিলাম, কটা দিন সুন্দরবন বা বেতলার জঙ্গলে গিয়ে পা ঢাকা দেব। খরচাপাতি নিয়ে চিন্তা নেই।
হইলেন। তিনি বলিলেন, কি এক দুর্গন্ধ, অনুভব করিতেছেন। উহা নিবারণের জন্যে নাসিকা আচ্ছাদিত করিয়াছেন। তখন নবাব বলিলেন, তবে তিনি জাতিভ্রষ্ট হইয়াছেন; কারণ, “ঘ্রাণ অর্ধেক ভােজন।” শ্যাম রায় আপন অস্ত্রে আপনি আহত হইয়া, তাহা স্বীকার করিলেন। সে দিন হইতে তিনি জাতিভ্রষ্ট হইলেন। তাঁহার বংশীয়েরা চট্টগ্রামের মুসলমান-সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনও অগ্রগণ্য। ইহারা মুসলমান হইলেও আমরা ইহাদিগকে কুটুম্বের মত শ্রদ্ধা ভক্তি করি।
যাদের বিয়ে হল বইটি একান্তভাবেই বিবাহিতদের জন্য। বিবাহিত তরুণ দম্পতিদের উদ্দেশে বইটি লেখা হলেও সব বয়সের বিবাহিতরাই বইটি পড়তে পারবেন। তবে তাদের প্রাপ্তমনস্ক হতে হবে। একদা ‘হতাশ হবেন না’ ৩য় খণ্ডে দাম্পত্য জীবন নিয়ে যে আলােচনা শুরু করেছিলাম সেটি সূচনামাত্র। নারী-পুরুষের সম্পর্ক, সমাজ পরিবার ও সবার ওপর মানুষের ব্যক্তিগত মনস্তত্ত্ব। (তার আচরণ, স্বভাব, ভাবনা) ছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে আলােচনা করা যায় না। তাই আমি এ নিয়ে মােট পাঁচটি বই লেখার কাজ শুরু করি।
বাবার চাকরি ছিল রেলে। শৈশব ভাল করে পরিস্ফুট হয়নি তখননা, তার আগেই শুরু হল এক যাযাবর জীবন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কলকাতায়, আর যুদ্ধ থামবার আগেই বাবার সঙ্গে বদলি হয়ে ঘুরে ঘুরে আমরা সাতঘাটের জল খেয়েছি। বিহার, উত্তর বাংলা, পূর্ব বাংলা, আসাম। এক জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায়। পিছনে ফেলে এসেছি। পুরােনাে আসবাব, হেঁড়া বই, প্রিয় বন্ধু, পােষা কুকুর। কত কেঁদেছি, মনে মনে বলেছি—আমি এ জায়গা ছেড়ে কোথাও যাবাে না। পরে দেখেছি জীবন যা কেড়ে নেয় তাই ফিরিয়ে দেয় আবার। একটা সরে গিয়ে আর একটার কেমন জায়গা করে দেয়। পুরােনাে জায়গা ছেড়ে নতুন জায়গায় গিয়ে নির্লজ্জের মতাে বন্ধু পাতিয়েছি কতজনার সঙ্গে।
টাইটানিক জাহাজের মালিকের নাম ‘হােয়াইট স্টার লাইন। সংস্থাটি আমেরিকান হলেও এর সমস্ত সত্তাই ছিল ব্রিটিশ। কোম্পানির সব জাহাজই চলত ব্রিটিশ পতাকা নিয়ে। জাহাজগুলির কর্মী ও অফিসার—সবাই ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক। অবশ্যই কোম্পানির প্রধান প্রশাসক ব্রুস ইসমে ব্রিটিশ। তখন জার্মানির সঙ্গে রেষারেষির ফলে ব্রিটেনের জাহাজ তৈরির কারখানাগুলাে ভাবতে শুরু করে, কী করে আরও বড় জাহাজ তৈরি করা যায়।
ঔপন্যাসিক স্বয়ং যখন চয়ন করে নেন তাঁর উপন্যাসমালার এক-একটি আখ্যান, তখন নিশ্চিতভাবেই সেই নির্বাচনের পিছনে কোনো–না-কোনো অভিপ্রায় কাজ করে। ‘শ্রীবুদ্ধদেব গুহর স্বনির্বাচিত উপন্যাস’ (প্রথম খণ্ড) আমাদের বিস্ময় উদ্রেক করেছিল। সাতটি উপন্যাস নিয়ে শুরু হয়েছিল যে-সিরিজ, তাঁর দ্বিতীয় খণ্ডে এসে রচিত হয় এমন এক জীবন যে- জীবনকে ঘিরে এমন এক বহুমাত্রিক আখ্যান, যার সহস্র দ্বার অবারিত। উপন্যাসের এই সহস্র দুয়ার দিয়ে পাঠক পরিভ্রমণ করেন কথাসাহিত্যের ভুবনে।
হাট শেষে তারা উল্কোপাত করে বাড়ি ফেরে। হাতে থাকে গামছায় বাঁধা দেড় কেজি চাল। জলিল মােল্লা, খােকা কোটাল, নগেন কোরােংয়াঁ, যতীন বেরা, হরেন ঘােড়া, হিমু চেঁকি, অখিল ভোড় একদল গরু ব্যাপারীর দালাল, শনিবার উলুবেড়ের হাটবারের দিন পাঁচটা গ্রাম থেকে এসে জোটে বিড়লাপুরের তিন ফটকে পােলের ফেরিঘাটায়। জোয়ারে নৌকো ছাড়বে। ততক্ষণ বসে বসে গাঁজা ডলে রওশন। পালােয়ানের কাছে। রওশন পেতলের সাঁপি পরানাে বিরাট বড় অর্ডারী কোলকেতে একবারে এক ভরি গাঁজা চড়ায়। কোলজেয় বল থাকে তাে দম মারাে। খােকা বুড়াে বার দুই টেনে বুলবুল করে নীলচে ধোঁয়া ছেড়ে খ্যাকশিয়ালের মতাে খ্যাকখ্যাক করে কাশতে কাশতে বলে, ‘কোজে যেন কয়লা হয়ে যায় মাইরি।