সুখের হােক বা দুঃখেরই হােক পর্যটক জীবন বিচিত্র। আবার পর্যটনের ফলে যে অভিজ্ঞতা লাভ করা যায় তা বড় কম নয় ; কারও কারও জীবনে তা বড় সম্বল হয়ে থাকে। আমার মনে হয়, এই পবিত্র ভারতভূমির মধ্যে, তীর্থস্থান বলে যেগুলি আছে, সেগুলির কিছুটাও যদি দেখা যায় তাহলে আমাদের মনে সহজেই এ ধারণা প্রবল হয়ে ওঠে যে, সৌন্দর্যের উপাসক আমাদের পিতৃপুরুষেরা কি অসাধারণ উদার, লােককল্যাণের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐ স্থানগুলি তীর্থক্ষেত্র বলে আবিষ্কার এবং চিহ্নিত করে | গেছেন তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য। চিরশান্তির নিকেতন এই হিমালয় আজও আমাদের আনন্দের উৎস হয়ে আছে, এত দুঃখের মাঝেও।
নিজের জীবনকালের কথায় নিজের জীবনকে গৌন করে কালকে বড়ো করে শৈশবের কথা এবং কৈশোরের কথা লিখে সাহিত্য-জীবনের কথা লেখার সংকল্প যখন করেছিলাম তখন এ কাজ যে কত কঠিন তা ভেবে দেখিনি। লিখতে বসে মনে হচ্ছে এমন কঠিন কাজে হাত না দেওয়াই ভালো ছিল। সহজাত লিখনক্ষমতায় এমন কঠিন কাজকে সহজ করে তুলেছেন তিনি। উম্মোচিত হয়েছে তাঁর সৃজনজীবনের অন্দরমহল। সেই সঙ্গে, বিগত শতকের তিরিশের দশকের শুরু থেকে পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগ-আমাদের জাতীয় জীবনের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এই সময়পর্বকে চিনে নেবার আয়াসেও সহযোগ দান করে এই আত্মচরিতমূলক গদ্য।
অনেকে কমলাকান্তকে পাগল বলিত। সে কখন কি বলিত, কি করিত, তাহার স্থিরতা ছিল না। লেখাপড়া না জানিত, এমন নহে। কিছু ইংরেজি, কিছু সংস্কৃত জানিত। কিন্তু যে বিদ্যায় অর্থোপার্জন হইল না, সে বিদ্যা কি বিদ্যা? আসল কথা এই, সাহেব সুবাের কাছে যাওয়া আসা চাই। কত বড় বড় মূখ, কেবল নাম দস্তখত করিতে পারে,—তাহারা তালুক মুলুক করিল—আমার মতে তাহারাই পণ্ডিত। আর কমলাকান্তের মত বিদ্বান, যাহারা কেবল কতকগুলাে বহি পড়িয়াছে, তাহারা আমার মতে গণ্ডমূখ।
ওদের সরল বিশ্বাস দেখে মায়া হত। যে কোনও বিবাহিত মেয়েই সারা জীবন ধরে যেসব জিনিস কাছে নেই, থাকবার নয়, তাদের বাদ দিয়ে কাজ চালিয়ে যায়। কোনও বাড়িতে এমন পুরুষ দেখলাম না যে তাদের ধরবার সাধ্যি রাখে। ডিম বাদ দিলে যা কখনওই হবার নয়, মেয়েরা হামেশাই ডিম বাদ দিয়ে তাই করে নেয়— একথা পুরুষ ছাড়া সবাই মানে। আবার বলে কিনা মেয়েদের বুদ্ধি কম। সত্যি কথা বলতে কী, এই যে পুরুষানুক্রমে মেয়েদের বুদ্ধিহীনতার প্রবাদ চলে আসছে, এতে মেয়েদের কম সুবিধে হচ্ছে না। তা ছাড়া বেজায় বুদ্ধি না থাকলে মান্ধাতার আমল থেকে কেউ বােকা সেজে থাকতে পারত না। যাকগে, এখন চাকরে মেয়েদের কথাই হােক।
গল্প উপন্যাসের চেয়ে ২০০০ সালের ছেলেমেয়েদের জীবনে বড় হয়ে উঠেছে কঠিন কঠোর রূঢ় বাস্তবতা তীব্র প্রতিযোগিতা, মুল্যবোধের অবক্ষয়, বিশ্বায়নের খোলা জানালা দিয়ে ঝড়ের মত হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে অপসংস্কৃতি। অর্থনৈতিক অবক্ষয় ও দুর্নীতিপঙ্কিল সমাজ জীবনে বদ্ধ দমবন্ধকর পরিবেশে রোল মডেল বলতে এখন হয় চিত্ৰতারকা না হয় ক্রিকেট তারকা। এই অবস্থায় আগামী প্রজন্মের কথা ভেবে তাদের জন্য কলাম ধরছেন। একজন সাংবাদিক লেখক। জীবনসন্ধ্যায় এসে তিনি দেখেছেন, এই নেতিবাদী জীবনধারা থেকে আজকের প্রজন্মকে বাঁচাতেই হবে। তিনি বলছেন। আমি বহু ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের মধ্যে হতাশ হইনি, আপনারাও হতাশা হবেন না। যারা বড় হতে চাও তাদের জন্য লেখকের পথনির্দেশ : ইস্কুলে যা পড়ানো হয় না।
উত্তরবঙ্গের গ্রামীন লােকজীবনে বিশেষ করেছােটদেশী, বড়দেশী, পলি, বাবুপলি, কোচ, রায়কত, দেবংশী, মালি, বরঙ্গা প্রভৃতি রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে অতি প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন দেবদেবীকে পূজিত হতে দেখা যায়। বংশপরমম্পায় চলে এইসব দেব-দেবীর পূজা-পার্বণ ও লােকাচার। এইসব দেবদেবী হ’ল পরিবারে ও সমাজে সমস্ত শুভ ও অশুভের ত্রাণ কর্তা। দেবদেবতার প্রসন্ন ও অপ্রসন্নতার উপর নির্ভর করে নিজের ও দশের মঙ্গল ও অমঙ্গল। তাই, দেবদেবীর প্রতি এরা অন্ধ বিশ্বাসী এবং দেবদেবতার প্রভাব। এদেব জীবনে অপরিসীম।
ভারী ভারী পর্দাগুলােকে টেনে টেনে জানলা ছায়, কাচ ছায় ঈশা ঘরে ঘরে ঘুরে ঘুরে। হালকা হলুদের ওপর এক বর্ণচ্ছায় গাঢ় হলুদ মােটিফ বসানাে চমৎকার পর্দা সব বিপন্ন হয়ে পড়েছে। কেননা এ তাে রৌদ্রশােষক রং নয় একেবারেই। ঘন সবুজ, গাঢ় মেরুন কি খয়েরি ছিল ঠিকঠাক রং। কিন্তু রুচির সঙ্গে প্রয়ােজনের প্রায়ই মতে মেলে না। সাত হাজার টাকার পর্দা কিনে শেষ শীতে মুখ আলাে করে ফিরেছিল দম্পতি। হালকা চন্দন দেওয়াল। তাতে হলুদ পর্দার আভা সিলিং পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। কী সুন্দর! এখন রােদের তাপের সঙ্গে নিজের তাপ যােগ করে, ফেরত পাঠাচ্ছে সেই শখের পর্দা।
যাত্রার আগে কয়েকটি তথ্য আমরা সংগ্রহ করে নিয়েছিলাম। বরপেটা রােডের বাজারে রাত্রির আহার সেরে পরের দিনের খাদ্য সংগ্রহ করে নিতে হবে। কেন না, তারপর মাইল পঁচিশেকের মধ্যে আর কোনও দোকান নেই। চেক পোেস্ট থেকে প্রায় মাইল পনেরাে দূরে ঘন অরণ্যের মধ্যে ডাক বাংলােতে খাদ্য ব্যবস্থা রাখা সম্ভব হয় না। তবে বাংলােতে আমার নামে একটা ঘর আগে থেকেই রিজার্ভ করা আছে, সে জন্য চৌকিদার আমাকে ফেরাবে না, এবং আমি সঙ্গে চাল ডাল নিয়ে গেলে সে রান্না করে দেবে। মানস অরণ্যে দর্শনাথী অধিকাংশই সাহেব হয়, তারা সঙ্গে টিনের কৌটোয় খাদ্য ও পাঁউরুটি নিয়ে যায়। ডাকবাংলােয় আলাে নেই, আমাদের মােমবাতিও নিতে হবে সঙ্গে করে। বরপেটা রােড বাজার পৌঁছবার আগেই নিকষ কালাে রাস্তায় জিপ গাড়িটা দুবার হেঁচকি তুলে থেমে গেল। আমি সচকিতে ওঝাকে জিগ্যেস করলাম, কী হল?
খুব ছােটবেলা থেকেই আমার ভ্রমণের নেশা। সব সময় মনে হতাে, এই পৃথিবীতে জন্মেছি, যতটা পারি তা দেখে যাবাে না? কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও পয়সা তাে ছিল না, তাই জমাননা কুড়ি-তিরিশ টাকা হাতে পেলেই চলে যেতাম কাছাকাছি কোথাও। এক সময় জাহাজের নাবিক হবারও স্বপ্ন ছিল আমার। তা অবশ্য হতে পারিনি। তবে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত গেছি কয়েকবার। দেশের মধ্যে সব কটি রাজ্যে, পশ্চিমবাংলার মধ্যেও সব কটি জেলা এবং মহকুমা, এমনকী অনেক গ্রামে গ্রামেও ঘুরেছি। কখনাে রাত কাটিয়েছি গাছতলায়, কখনাে নদীর বুকে নৌকোয়, কখনাে পাঁচতারা হােটেলে। এই সব ভ্রমণ নিয়ে লেখালেখিও করেছি অনেক। এখন দেখতে পাচ্ছি সেইসব লেখা জমে জমেও প্রায় পাহাড় হয়ে গেছে।
দেশীয় শিল্প-বাণিজ্যের অবনতি ও ক্রমবর্ধমান কৃষিজীবী শ্রেণি জমিদারের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে বেশ বাড়িয়ে দিয়েছিল। সহযােগী শ্রেণি হিসাবে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের নিকট জমিদারদের মর্যাদা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তাছাড়া ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছিল মেকলের ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণি, যারা ইউরােপীয় সভ্যতা ও জীবনধারা তামাম ভারতবাসীর নিকট যথার্থভাবে ব্যাখ্যা বা interpret করে তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের সমর্থক করে তুলবে। এই interpretor শ্রেণিও ছিল সাম্রাজ্যের স্থায়ীত্বের ভরসাস্থল।
লাইব্রেরি একটি জনহিতকর প্রতিষ্ঠান। এটি সমাজের সকল স্তরের সকল শ্রেণীর মানুষজনকে সেবা প্রদান করে। স্বাক্ষরতা থেকে শুরু করে শিক্ষা জগতের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত সর্বস্তরেই গ্রন্থাগার উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে। সমাজের সার্বিক উন্নয়নে গ্রন্থাগারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল এগুলি সবই সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে চিহ্নিত। এগুলি সমাজে বিভিন্নভাবে অবদান রাখে। তেমনি সমাজের প্রতি গ্রন্থাগারের অবদানের কথা স্মরণ করে এটিকেও সামাজিক প্রতিষ্ঠান বলা চলে।
জীবনে অনেক জিনিস ঘটে, যাহার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় —তাহাকে আমরা অতিপ্রাকৃত বলিয়া অভিহিত করি। জানি না, হয়তাে খুঁজিতে জানিলে তাহাদেরও সহজ ও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক কারণ বাহির করা যায়। মানুষের বিচার, বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতালব্ধ কারণগুলি ছাড়া অন্য কারণ হয়তাে তাহাদের থাকিতে পারে—ইহা লইয়া তর্ক উঠাইব না, শুধু এইটুকু বলিব, সেরূপ কারণ যদিও থাকে—আমাদের মতাে সাধারণ মানুষের দ্বারা তাহার আবিষ্কার হওয়া সম্ভব নয় বলিয়াই তাহাদিগকে অতিপ্রাকৃত বলা হয়।
পাড়াটায় ছ-সাত ঘর ব্রাত্মণের বাস মােটে। সকলের অবস্থাই খারাপ। পরস্পরকে ঠকিয়ে পরস্পরের কাছে ধার-ধাের করে এরা দিন গুজরান করে। অবিশ্যি কেউ কাউকে খুব ঠকাতে পারে না, কারণ সবাই বেশ হুঁশিয়ার। গরিব বলেই এরা বেশি কুচুটে ও হিংসুক, কেউ কারও ভাল দেখতে পারে না, বা কেউ কাউকে বিশ্বাসও করে না।
সকলের চেয়ে কাজ বাড়ে পূজো-আচ্চার দিনে—এ বাড়িতে বারাে মাসের বারােটা - পূর্ণিমাতে নিয়মিত ভাবে সত্যনারায়ণের সিন্নি হয়। গৃহদেবতা শালগ্রামের নিত্যপূজা তাে আছেই। তা ছাড়া লক্ষ্মীপূজা মাসে একটা লেগেই থাকে। এসব দিনে সংসারের দৈনিক বাসন বাদে পূজোর বাসন বেরােয় ঝুড়িখানেক। এঁদের সংসার অত্যন্ত সাত্ত্বিক গোঁড়া হিন্দুর সংসার পুজো-আচ্চার ব্যাপারে পান থেকে চুন খসবার জো নেই। সে ব্যাপারে দেখাশুননা করেন জ্যাঠাইমা স্বয়ং। ফলে ঠাকুরঘরের কাজ নিয়ে যাঁরা খাটাখাটুনি করেন, তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে।