কামরা থেকে একটা একটা করে মালপত্র নামাচ্ছিল শুভ্র আর পল্লব। ব্যস্তসমস্ত মুখে। সতর্ক চোখে। একটু অসাবধান হলেই কে কোথায় কোন্ মাল নিয়ে চম্পট দেয় তার ঠিক কী! পুরী ধর্মস্থান বটে, তবে কে না জানে পুণ্যক্ষেত্রেই চোর ছাচোড়ের উপদ্রব বেশি। জগন্নাথ এক্সপ্রেস আজ ঘণ্টা দেড়েকের ওপর লেট। ভুবনেশ্বর অবধি ঠিকঠাকই চলছিল, খুদাররাডে এসে খামােকা দাঁড়িয়ে রইল নিঝুম। ছাড়েই না, ছাড়েই না। যাও বা ছাড়ল বাকি পথ এল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। একটু থামে, একটু চলে, থামে... কোথায় সাড়ে পাঁচটায় ইন করে যাওয়ার কথা, সাতটা বাজিয়ে দিল।
বালিগঞ্জ প্লেসের এই একতলা বাড়িটার দক্ষিণ কোণের ঘরটা সত্যিকারের আর্টিস্ট ভাবুক মানুষের পক্ষে একটি আদর্শ আশ্রয়। জানালার পাশেই মাঠটার আরম্ভ। কলকাতার বর্ষার আদরে ঘাসভরা মাঠটা যেন আহ্লাদে কেঁপে উঠেছে সতেজ সবুজে কানায় কানায় ভরা। চারদিকের পীচ ঢালা চারটে রাস্তা যেন পালিশ করা চারটে কালাে ফ্রেম, এই সবুজের উচ্ছলতাকে শক্ত করে বেঁধে রেখেছে। জানালার ঠিক বাইরেই পর পর কতগুলি কাঠাল আর শিউলি—একটা বারােমেসে. ছায়া জায়গাটাকে যেমন ঠাণ্ডা তেমনি স্যাতসেঁতে করে রেখেছে। গাছের গােড়ায় কদিন থেকে ঝরা শিউলি জমে উঠেছে।
সাহিত্য শিল্পের একটা ঐতিহ্য আছে। ধারাবাহিকতা অস্বীকার করা মুশকিল। সচেতনভাবেও কি তা অমান্য করা যায় ? বােধ হয় নয়। এই সংকলনেই এমন কয়েকটি লেখা আছে যা আমাদের বাংলা ছােটগল্পের ঐতিহ্যকেই মনে করিয়ে দেয়। এতে দোষের কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। লেখক মাত্রেই তাঁর মনােমতন লিখবেন—সেটাই তাে স্বাভাবিক। পাঠকের পছন্দ হােক না-হােক লেখক কেনই বা অন্যের মরজিতে লিখতে যাবেন!
নিরীহ কুঞ্জ আর কথা কহিতে পারে না। তাহার এই শিক্ষিতা তেজস্বিনী ভগিনীটির সুমুখে সে কেমন যেন থতমত খাইয়া যায়। তথাপি সে ভাবে, আর একরকম করিয়া। সে বড় দুঃখী। এই দুখানি কুটীর এবং তৎসংলগ্ন অতি ক্ষুদ্র একখানি আম-কাঁঠালের বাগান ছাড়া আর তাহার কিছু নাই। অতএব নগদ এতগুলি টাকা এবং এত জোড়া ধুতিচাদর তাহার কাছে সােজা ব্যাপার নহে। তবুও এই প্রলােভন ছাড়াও, সে তাহার একমাত্র স্নেহের সামগ্রীকে এই ভাল জায়গাটিতে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া, তাহাকে সুখী দেখিয়া নিজেও সুখী হইতে চাহে।
মনুষ্য লেভেলে নামিয়া আসিলেই আমাদের বিচার, দৃষ্টিভঙ্গি সকলই পাল্টাইয়া যায়। মানবজগৎ বড়ই জটিল। মানবের সুখ-দুঃখের হিসাব, ভাল-মন্দের মানদণ্ড অত সহজ নহে। তাই, উপরের লেভেলে পুরাণ লেখা হয়, মনুষ্যে উপন্যাস লেখে। উপন্যাস মনুষ্য চরিত্র, তাহাতে নানা বর্ণছায়ের খেলা, তাহার জীবনের চলনপথ এই সকল লইয়া ব্যাপৃত হইয়া থাকে। মহা আনন্দে, কেননা ইহা সােজা সরল নয়। উপরন্তু ইহা সত্য অথচ সর্বাংশে সত্য নয়, বিস্তর বানানাে-বিনাননা আছে, তাহাতেই মজা, ছিল রুমাল হইয়া গেল বিড়াল। ক-এর বাবার সঙ্গে গ-এর জ্যাঠামশাইকে চালিয়া চালিয়া চালনিতে মিশানাে হইল, কিছু রং চড়িল, কিছু রং ওয়শ করিয়া করিয়া ফিকা হইল, আরও কতক অদ্ভুত রাসায়নিক পরিবর্তন হইল, উপন্যাসের পিতা দুগগি তৈয়ার হইলেন।
দুপুরগুলাে তখনও ঠিকঠাক মাপের দুপুর। মা ভাতঘুমে। চৌকো বাক্স ছাপিয়ে উঠছে গমগমে কণ্ঠ, বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা। বাগানে ঝরে পড়া কুল বা সুপারীর সাথে তখন সখ্যতা। বালিতে লুকিয়ে আছে ছােট্ট ঝিনুক, খুঁজে পেলে আনন্দে আত্মহারা। কুড়িয়ে পাওয়া কত কী তখন নিজের বলে মনে হতে শুরু করেছে। অধিকার বােধ কি তখন থেকেই মাথা উঁচু করে! অথচ যা কিছু নিজের ভাবি সবই তাে সরে যায় দৃষ্টি সীমানা থেকে! প্রথম সেলাই করা গােলাপ সমেত রুমাল হারিয়ে যায় সমুদ্দরে। আর কত ঢেউ। উঁচু নীচু ঢেউয়ের মাথায় চড়ে রুমাল যায় তেপান্তরে। হারিয়ে যায় মােম-কাগজের তৈরি পরীহয়ে ওঠার দুই ডানা। ইকারুস ডাক পাঠিয়েছিল নির্ঘাত নইলে কী আর নিষেধ ভুলে উড়তে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ি কিনা জলন্ত চুলাের কাছে।
ভােরবেলা থেকে পেঁজা তুলাের মতন পাতলা তুষার দুলতে দুলতে নামছে। বৃষ্টির শব্দ থাকে, কিন্তু তুষারপাত একেবারে নিঃশব্দ। আস্তে আস্তে সাদা হয়ে আসছে গাছগুলাের মাথা। এদিকটায় নদীর ধারে সারি সারি উইলাে গাছ, ঝুঁকে আছে জলের দিকে। এই গাছগুলির নাম উইপিং উইলাে, দেখলেই কেমন যেন করুণ আর বিষন্ন মনে হয়। আরও অনেক গাছ এখানে, তার মধ্যে পপলার ও মেপ্ল চেনা যায়।
মােট কথা আমি কখনাে তােকে ছেড়ে থাকতে পারতাম না, তুইও কখনাে আমাকে ছেড়ে থাকতে পারতিস না। তাই তাে কোনােদিন আমার মা আমাদের দুজনকে দু’পাশে নিয়ে ঘুমুতেন ; আবার কোনােদিন নতুন মা আমাদের দুজনকে দু’পাশে নিয়ে শুতেন। এইভাবেই কেটেছে আমাদের ছােটবেলা। একটু বড় হবার পর আমার দাদা আমাদের দু’জনকে নিয়ে পার্কে বেড়াতে যেত। পার্কে গেলে আমরা প্রাণভরে দৌড়াদৌড়ি করতাম, দোলনায় চড়লে দাদা আমাদের দোল দিত। খুব মজা লাগত দোলনায় চড়তে।
কলকাতা থেকে প্রায় সাতাশ মাইল দূরে এই বিপুলায়তন বাগানবাড়িটা প্রায় সকলের চোখে পড়ে। চৌত্রিশ নম্বর ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে বহরমপুর, মালদা কিংবা শিলিগুড়ির দিকে পাড়ি দিলে বাগানবাড়িটা ঠিক পথের ধারে না হলেও সামান্য একটু ভিতরে রয়েছে। গাড়ি থেকে অবশ্য বাগানবাড়ির গেট বা প্রবেশদ্বার চোখে পড়বে। কী যেন একটা নাম আছে বাগানবাড়িটার। হ্যা, বলছি সেটা। বাগানবাড়িটার নাম মনােমুকুর অর্থাৎ মনের আয়না বা মনের মুকুর।