জয় গোস্বামী খুব বেশিদিন যে লিখছেন, তা নয়। কিন্তু শুরু থেকেই আদায় করে নিয়েছেন স্বতন্ত্র একটি স্থান, কাব্যপাঠকের আলাদা রকমের সমীহ । তার কবিতার সঙ্গে অন্য কারোর লেখারই তুলনা চলে না। সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি ভাষায় লেখেন জয় গোস্বামী । ছন্দ জানেন, ছন্দ ভাঙতে জানেন, জানেন ছন্দ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার খেলাও । শব্দ ব্যবহারেও তিনি বেপরোয়া ও দুঃসাহসী | যে-সব শব্দ নিতান্ত আটপৌরে কিংবা অতিরিক্ত গদ্যবাদী বলে কবিতায় সভয়ে বর্জিত, নিজের কবিতার মধ্যে অবলীলাক্রমে সে-ধরনের শব্দ ব্যবহার করেন। তিনি । ব্যবহার করেন। সেইসব শব্দও যা পদ্য-অনুষঙ্গী | এর অন্যতম কারণ হয়তো এই যে, কবিতা যে শেষ পর্যন্ত ছন্দ-শব্দ পাের হয়ে উত্তীর্ণ হয় এক অলৌকিক রসের জগতে ; বয়সে তরুণ তবু অভিজ্ঞতায় পরিণত এই কবি প্রথম থেকেই সে-কথা জেনে গেছেন । সম্ভ্রান্ত ও সংকেতময়, গুঢ় ও গভীর, প্রেমের ও শোকের একগুচ্ছ কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হল জয় গোস্বামীর নতুন এই কাব্যগ্রন্থ।
সে বড় নিকটকথা যা বর্ণনা করি
কিছু বলব ধীরে আস্তে, কিছু তড়িঘড়ি
কিছুটা অতীতে ঘটল, কিছু বা এক্ষুণি।
কিছু তার চোখে দেখা কিছু কর্ণে শুনি
কিছু তার মেঘে রইল কিছু বৃষ্টিপাতে।
ধুয়ে মুছে মনে আসছে দিবসে ও রাতে
কাক-পক্ষী:মুখে করে নিয়ে গেল কিছু |
কিছু উড়ল কুটো হয়ে বাতাসের পিছু
কথাখানি উড়ে গিয়ে যথা তথা পড়ে
শুনে কেউ মুগ্ধ কেউ চক্ষু বড় করে
দু’আনি চারআনি দিয়ে কথা শুনতে হয়
এ কথা তেমন কথা নয় মহাশয় |
রক্তজবার গােড়ায় খুঁড়ছি মাটি
তােমার মন কি মাটির ভিতরে আছে?
আমার জবা যে আপাতত চারাগাছ।
কিছু বড় হােক, যাব যুবকের কাছে।
রক্তজবার গােড়ায় ঢালছি জল
জলের মতন সমতল হােক প্রাণ
রক্তজবা যে চলল যুবক হতে
ওর যৌবনে আমারও কি সম্মান?
রক্তজবার পাপড়ি দেখব কবে
করে ছুঁতে পাব গভীর কোমল চোখ
মনভাল’র থেকে যেসব কবিতা লেখা হয় তারা অনেকটা বাড়ির ছােট মেয়ের মতাে। ফর্সা, চুল ছােট করে ছাটা, আদরের, গানের ক্লাসে যাওয়া ফুটফুটে। একটা মেয়ে। মন খারাপের থেকে যে-সমস্ত কবিতা উঠে আসে তারা বাড়ির বড় মেয়ের মতাে। চাপা রং, চুলঠোটনখে অযত্ন, দু’বার পাত্রপক্ষ ফিরে যাওয়া, সেলাইফোঁড়াই জানা একটা মেয়ে। আমি শুধু চেয়েছিলাম এই দুই বােনের মধ্যে রােগাসােগা, একরােখা, বদমেজাজি একটা ছেলে, যে অনেক রাত অব্দি গান শােনে, আর যার বন্ধু নেই কোনাে।
যে স্টেশনে নেমে গেলে, তার নাম: হৃদয়পুর হল্ট! দুপুরে, শিথিল হাওয়া প্লাটফর্মে, পাতায় পাতায় গাছ থেকে ঝরে পড়ছে ফায়ূনের নিরুদ্বেগ রােদ, পুকুরে সামান্য ঢেউ, গামছা পরে যে-ছেলেটি জলে নামল, আজ কি তার প্রতিষ্ঠাদিবসে স্কুল ছুটি ? জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি, দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছ, সাদা ওড়না উড়ছে, রাস্তার ওপারে একতলা, নারকেলগাছভর্তি নীল বাড়িতেই তুমি থাকো?
প্রথমেই জানিয়ে রাখতে চাই যে, এই বইতে যাঁরা বিশুদ্ধ কবিতার রস খুঁজতে যাবেন, তাঁদের নিরাশ হবার সম্ভাবনাই খুব বেশী । এ বইতে কবিতা নেই, আছে অনুবাদ কবিতা। অনুবাদ কবিতা একটা আলাদা জাত, ভুল প্রত্যাশা নিয়ে এর সম্মুখীন হওয়া বিপজ্জনক। অনুবাদ কবিতা সম্পর্কে নানা ব্যক্তির নানা মত আছে, আমি এতগুলি কবিতার অনুবাদক, তবু আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস, অনুবাদ কবিতার পক্ষে কিছুতেই বিশুদ্ধ কবিতা হওয়া সম্ভব নয়, কখনাে হয়নি। কোলরিজ বলেছিলেন, একটি কবিতার সেইটুকুই বিশুদ্ধ কবিতা, যার অনুবাদ সম্ভব নয়। সেই বিশুদ্ধ ব্যাপারটি কি তা বুঝতে হলে, আর একটি বিশুদ্ধ কবিতা পড়ে দেখতে হবে, আজ পর্যন্ত কোনাে সমালােচক তার বর্ণনা করতে পারেননি। কবিতার সংজ্ঞা, ব্রহ্মেরই মতন, অনুচ্ছিষ্ট। সংজ্ঞা না হােক, এই সরল সত্যটি সর্ববিদিত যে, কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য তার শব্দ ব্যবহার, বিংশ শতাব্দীর কবিতা সঙ্গীতের প্রভাব কাটিয়ে শব্দের গভীর অর্থের প্রতিই বেশী মনােযােগী, এবং এক ভাষার শব্দ চরিত্র অপর ভাষায় হুহু প্রকাশ করা একেবারে অসম্ভব।
ঘূর্ণিত পতন আছে আশেপাশে যােজন-গভীরে,
অসম্ভব অভিপ্রায় দোলায় শিকড়-ফাটা মাটি,
দ্বিখণ্ডিত রশ্মি হায় নিরুদ্দিষ্ট দিগন্ত-সমীরে।
বঞ্চিত সে-দ্বিপ্রহর পুড়ে পুড়ে হয়েছে কি খাঁটি?
দীর্ঘশ্বাসে তীক্ষ্ণ ধার, কলঙ্ক পড়েছে সাদা চাদে ;
ঊর্ধ্বরেখা হ্রস্বতর, হ্রস্বতর মনের কথাটি।
এমন আকাশ হবে তােমার চোখের মতাে ভাষাহীন নির্বাক পাথর, দৃষ্টি তার স্থির হবে মৃতের প্রাণের মতাে উদাসীন নির্মম শীতল, তুমি আছাে সর্বময় রাত্রির গহনে মিশে –আমি এক ক্লান্তির কফিনে, তুমি যদি মৃত্যু আনাে অবসাদে মূক আর কঠিন কুটিল রাত্রি জুড়ে হে আমার তমস্বিনী মর্মরিত রাত্ৰিময় মালা, মৃত্যুফুলে বেদনার প্রাণদাহী ফুলে ফুলে হে আমার উদাসীন মালা, আমার জীবন তুমি জর্জরিত করাে এই দিনে রাত্রে দুপুরে বিকেলে এবং আমাকে বলাে,
প্রকাশিত হলো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ কবিতা সমগ্র্র’র প্রথম খণ্ড , যার মধ্যে গ্রথিত হয়েছে তার ছ’টি কাব্যগ্রন্থ ; ‘একা এবং কয়েকজন’, ‘আমি কি রকমভাবে বেঁচে আছি’, ‘বন্দী , জেগে আছো’, ‘আমার স্বপ্ন’, ‘সত্যবদ্ধ অভিমান’, ও ‘জাগরন হেমবর্ণ’। বাংলা কবিতার যারা প্রেমিক পাঠক , তাদের কাছে এ এক মস্ত খবর সন্দেহ নেই। কেননা ,বাংলা কথাসাহিত্যের সেরা একজন লেখক যিনি, সেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যে বাংলা কবিতারও এক অতিশক্তিমান স্রষ্টা , তা কে না জানে। এই কথাটাও সবাই জানে না যে, পঞ্চাশের শতকে ‘কৃত্তিবাস’ নামক যে আন্দোলন একদিন বাংলা কবিতার মোড় একেবারে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল , সুনীলই ছিল তার নেতৃস্থানীয় কবি। পাঠক , সমালোচক সবাই সেদিন অবাক মেনে নিয়েছিলেন। সবাই লক্ষ্য করেছিলেন যে ,এই কবি কোনও পুরনো কথা শুনাচ্ছেন না। তিনি যা কিছু লিখছেণ তারই ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে এক ঝলক টাটকা বাতাস। আর সেই বাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছে এমন এক সৌরভ, যা তার আগে পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
দুলে দুলে দুলে দুলে মাটি ওঠে ফুলে ফুলে বাড়ি যাও বাড়ি যাও বাড়ি যাও বাড়ি যাও, দেখাে হাতলণ্ঠনে আছে কিনা কেরােসিন। দেখাে পথ দেখে চলাে, পেটে খিদে বড় খিদে, বাড়ি গেলে সব পাবে লেবু আছে নুন আছে, কঁচা লঙ্কাও গাছে, আছে আছে সব আছে। নেই নেই, পান্তার হাঁড়িতে যে হু হু হাওয়া, কেন এত হু হু হাওয়া ফুটো হাঁড়ি চোখ আঁকা, জল ছছাটে আঁকাবাঁকা চৌকাঠে ভাঙা শাখা নেই নেই ভাত নেই, আমানি ও চিড়ে নই, গুড় নেই খই নেই। কী খাবে গাে খাবেটা কী, খিদে জ্বলে দাউ দাউ পেটে কিল পেটে কিল বউ ছেলে কোথা গেল, ছােট মেয়ে কঁদুনিটা, সেই মেয়ে কোথা গেল ঘরে নেই কেউ নেই, আলাে নেই ঘর নেই, দেয়ালের চকখড়ি দাগ নেই দাগ নেই, বসুধারা মুছে গেছে, ঘরভরা ভাঙা কাচে তালগাছে কেউ নেই, পুকুরেও কেউ নেই,
এ যে আমার সাড়ে তিন হাতের মস্ত জমিদারি এর নাই কোনও শরিক, নাইকো দখলদারি। দুইখান বাতি জ্বলে আর নেভে, ব্যস্ত সেরেস্তাখানা আসা যাওয়ার দরজা খােলা, তবু ভিতরে যেতে মানা। দুনিয়া যখন হাতছানি দেয়, এক নয়নে কান্দি যে আমারে দুরে ঠেলেছে, তারেই দু’হাতে বান্ধি। দুই কান ধরে সদা টান মারে স্বর্গ-নরকের দ্বারী তবু এ আমারই সাড়ে তিন হাতের মস্ত জমিদারি।
তারপর ধর্ম বক বললেন, বৎস,
তােমাকে আমি আরও তিনটি প্রশ্ন করব।
বলাে তাে, মানুষের কোন কষ্ট মুখের ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না।
কিংবা বলতে গেলেও কেউ বুঝবে না?
মুহূর্তমাত্র চিন্তা না করে যুধিষ্ঠির বললেন,
কোনাে কবি যখন ভাব প্রকাশের জন্য প্রকৃত ভাষা খুঁজে
পায় না তখন তার যে কষ্ট তা দ্বিতীয় কোনাে ব্যক্তির পক্ষে।
সহমর্মী হওয়া সম্ভব নয়।
তেমনি তাঁর সমসাময়িক অনেক লেখকও রচনা করেছেন তাঁর সম্পর্কে প্রশস্তি গাথা। উনিশ শশা তিরিশের দশকে বাংলা সাহিত্য তাঁর বিরুদ্ধে এক প্রকার আন্দোলন শুরু করে। তৎকালীন তরুণদের এই যে রবীন্দ্র-বিরােধিতা, তা কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে হেয় করবার জন্য। মমাটেই নয়, এরা সকলেই রবীন্দ্রনাথকে শ্রেষ্ঠত্বের সিংহাসনে বসিয়ে রেখেছিলেন, এরা শুধু প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলেন যে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র-রীতির অনুসরণ করা হবে না। এই সব তরুণেরা প্রকাশ্যে উচ্চ কণ্ঠে রবীন্দ্র-বিরােধী কথাবার্তা বললেও রাত্রে নিজের ঘরে শুয়ে। শুয়ে অনর্গল রবীন্দ্রনাথের কবিতা মুখস্থ বলে যেতেন, এমন দৃষ্টান্তও আছে। কিছুদিন আগে পরে হলেও রবীন্দ্র-উত্তর যুগের প্রধান সাহিত্যিকগণ প্রত্যেকেই আন্তরিকভাবে রবীন্দ্র-বন্দনা রচেছেন।
জোরা নীল হার্সটন হারলেম রেনেসাঁস’ সময়ের একজন প্রধান বুদ্ধিজীবী। তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ নিগ্রো অভিব্যক্তির চরিত্র থেকে কিছু সারাংশ এখানে তুলে ধরছি যাতে আফ্রিকান আমেরিকান কবিদের লেখা বুঝতে সুবিধে হয়। আমেরিকায় একটা বিখ্যাত টিভি সিরিয়াল ছিলনাম ‘টুইলাইট জোন’। তার একটা অংশের শুরু হচ্ছে একজন দারুণ সুন্দরী সাদা, সােনালি চুল, নীল চোখ মেয়ের অপারেশন হচ্ছে। তাকে ঘিরে রেখেছে কিছু মুখে সাদা কাপড় লাগানাে ডাক্তারের দল।