Categories


ঝাঁপ ও অন্যান্য গল্প

সেখানে প্লাস্টিকের সস্তা সােফা আর তার সাথে মানানসই ইজি চেয়ার। লিফটটা ওপরনিচ ওঠানামা করে। ফাঁকা হল, সভাকক্ষ, ট্রপিকানা বুফে, দ্য মারমেইড বার লেখা সাইনবাের্ডগুলাে পেরিয়ে এখানে তাকে আনা হয়েছে। যেন সিনেমার ক্যামেরার ভেতর দিয়ে দৃশ্যটা এগিয়ে যায়। ধারাবাহিকভাবে একটার পর একটা দৃশ্য বদলে শেষে দেয়াল ভেদ করে একটা প্রতিকৃতির সামনে এসে দাঁড়ায়। একজন নায়কের প্রতিকৃতি; নাকি একজন দুষ্কৃতকারীর- তার নিজের!


উত্তরপুরুষ

জয় করবে বলেই জন্মেছে মানুষ, হারবে বলে নয়। একজন মানুষ কখনো হেরে যেতে পারে না, যদিও সে নিঃশেষ হয়ে যায়। লড়াই করে বেঁচে থাকার এমন দশটি গল্প নিয়ে দীপু মাহমুদের গল্পগ্রন্থ ‘উত্তরপুরুষ’।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তাঁর লেখক সত্তাকে বারবার নাড়া দিয়েছে। প্রতিটি গল্পগ্রন্থের নাম দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গল্পের নামে। এই সংকলনের প্রথম গল্প উত্তরপুরুষে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের এক ভিন্নতর রূপ। মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পর এই গল্পে আমাদের মুখোমুখি হতে হয়েছে নির্মম এক কঠিন সত্যের, যে কাহিনির শুরু ১৯৭১ সালে। অন্য গল্পগুলোতেও দেখা যায় জটিল ও ভালোবাসাময় জীবনের আবেগকম্প হৃদয়ানুভূতির মননশীল প্রকাশ।

এই বইয়ের গল্পগুলোতে বাঙালির গর্বের মুক্তিযুদ্ধ আছে, লড়াই করে বেঁচে থাকার প্রত্যয় আছে, আছে প্রেম-বোধ-অনুভূতি-কল্পনা-আশা যা আমরা অনুভব করি প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে। বাস্তব আর জাদবাস্তবতার মিশেলে দশটি গল্পের অনবদ্য নিপুণ সৃষ্টি এই ‘উত্তরপুরুষ’।


অরণ্যে যুদ্ধ

প্রায় বছর তিনেক আগের ঘটনা। আহ্বানটি এসেছিল দৈনিক নিউএজ পত্রিকার সম্পাদক প্রিয় বন্ধু নূরুল কবীরের কাছ থেকে। তাঁরই সম্পাদনায় একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতে যাচ্ছে, সেটির জন্য কিছু অনুবাদের কাজ করে দিতে হবে আমাকে। এমন আহ্বানে সানন্দে সাড়া দেয়া ছাড়া বিকল্প থাকে না। একদিন পত্রিকা অফিসে গিয়ে জানতে পাই, আরেক পরিচিত সাংবাদিক আমীর খসরু সাপ্তাহিক বুধবার নামে প্রকাশিতব্য সেই পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছেন। সাথে আছেন চন্দন সরকারও। চন্দনদাই ধরিয়ে দিলেন ইন্টারনেট থেকে ডাউন লােড করা অরুন্ধতী রায়ের ওয়াকিং উইথ দি কমরেডস লেখাটি। বাসায় নিয়ে পড়লাম । ভাল লাগলাে । অনুবাদ করতে গিয়ে ভালােলাগার মাত্রাটা যেন একটু বেড়েই গেল। লেখকের কোনাে কোনাে বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পােষণ করার অবকাশ থাকলেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা, চিন্তার সততা এবং ঘটনা বর্ণনার বস্তুনিষ্ঠতায় মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না।


উত্তরাধিকারী

আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলাে আলবেনিয়া সরকারের বিবৃতি উদ্ধৃত করে খবরটা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। বিকেল বেলা, প্রথমে যুগােস্লাভ রেডিওর খবরে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়, এটা কি সত্যিই আত্মহত্যা ছিল, না কি হত্যা? তারপরই সংবাদ সংস্থাগুলাে নিজেদের বুলেটিনে দুই সম্ভাবনার কথাই উল্লেখ করতে শুরু করে।


সমরখন্দ

সমরখন্দ গ্রন্থটির কাহিনী রুবাইয়াৎ-ই ওমর খৈয়ামের পাণ্ডুলিপি নিয়ে। একেবারে কবির রচনার কাল থেকে শুরু কর একাদশ শতাব্দীর পারস্য এবং ১৯১২ সালে টাইটানিকের সঙ্গে এর হারিয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর বর্ণনা রয়েছে এতে। ১০৭২ সালে সমরখন্দের রাস্তায় এক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার পর ওমর খৈয়ামকেম হাজির করা হয়েছিল স্থানীয় এক কাজীর দরবারে,যিনি বুঝতে পেরেছিলেন কবির মেধা এবং দিয়েছিলেন একটা আনকোরা মোটা খাতা, যাতে লেখা হয়েছিল অমর কাব্য পঙ্‌ক্তিমালা। সে যাত্রা ওমর খৈয়াম বেঁচে দিয়েছিলেন এবং সৃষ্টি হয়েছিল তাঁর রুবাইয়াৎ। তাঁর জীবন সুতোর নক্সা বুনেছিলেন সম্রাটের পরাক্রমশালী উপদেষ্টা নিজাম-উল-মূলক এবং হাসান সাব্বাহ- আত্নঘাতী মৌলবাদের (অ্যাসিসিন এর) প্রবর্তক ,যিনি তার দুর্ভেদ্য পার্বত্য দুর্গে লুকিয়ে রেখেছিলেন ঐ মহামূল্য পাণ্ডুলিপিটি।সেখানেই ওটা ছিল দেড়শ’ বছরের মতো। ঊসবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এডওয়ার্ড ফিৎজোরাল্ডের অনুবাদের কল্যাণে পশ্চিমা বিশ্বের ভাবজগৎ উন্মতাল হয়ে ওঠে ওমর খৈয়াম নিয়ে। জানতে পারেন এবং পারসিক এক রাজকুমারীর সহায়তায় উদ্ধার করেন সেটি। দু’জনে মিলে ওটা নিয়ে যাত্রা করেন নিয়তিতাড়িত জাহাজ টাইটানিকে।


কেরী সাহেবের মুন্সী

বছর পনেরো আগে রােমরাম বসুর জীবন নিয়ে কিছু একটা লিখবার ইচ্ছা হয়, তখন ধারণা ছিল না যে তা ঠিক কি আকার ধারণ করবে। তার পরে বিষয়ের মধ্যে প্রবেশ করে বিস্মিত হয়ে গেলাম। রামরাম বসু প্রসঙ্গে উইলিয়াম কেরীকে পেলাম। বুঝলাম যে যে-সব মহাপ্ৰাণ ইংরেজ এদেশে এসেছেন, উইলিয়াম কেরী তাঁদের অগ্রগণ্য। কেরীর ধৰ্মজীবন, ধর্মপ্রচারে আগ্রহ, বাংলা গদ্য সৃষ্টিতে নিষ্ঠা ও অধ্যবসায় অভিভূত করে দিল আমাকে । তখন ধীরে ধীরে কেরী ও রামরাম বসুকে অবলম্বন করে কাহিনীটি রূপ গ্ৰহণ করে উঠল। এই কাহিনীকে পাঠক ঐতিহাসিক উপন্যাস বলে গ্ৰহণ করবেন। কিনা জানি না, করলে আমার আপত্তির কারণ নেই। ১৭৯৩ থেকে ১৮১৩ সালের ইতিহাস এর কাঠামো। জ্ঞানত কোথাও ইতিহাসের সত্য থেকে বিচ্যুত হইনি। কেবল একটি বিষয়ে কিছু স্বাধীনতা নিয়েছি, দ্বারকানাথ ঠাকুরের বয়স কিছু বাড়িয়ে দিয়েছি! আর কিছুই নয়, রবীন্দ্রনাথের পিতামহকে কাহিনীর মধ্যে আনবার লোভ সম্বরণ করতে পারি নি। ইতিহাসের সত্য ও ইতিহাসের সম্ভাবনা ঐতিহাসিক উপন্যাসকারের উপাদান। ইতিহাসের সত্য অবিচল, তাকে বিকৃত করা চলে না। ইতিহাসের সম্ভাবনায় কিছু স্বাধীনতা আছে লেখকের। সত্যের অপব্যবহার করি নি, সম্ভাবনার যথাসাধ্য সদ্ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছি। দুই শ্রেণীর নরনারীর চরিত্র আছে উপন্যাসখানায়, ঐতিহাসিক আর ইতিহাসের সম্ভাবনা-সঞ্জাত। কেরী, রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, টমাস, রামমোহন, রাধাকান্ত দেব প্রভৃতি ঐতিহাসিক চরিত্র। রেশমী, টুশকি, ফুলকি, জন স্মিথ, লিজা, মোতি রায় প্রভৃতি ইতিহাসের সম্ভাবনা-সঞ্জাত অর্থাৎ এসব নরনারী তৎকালে এইরকমটি হত বলে বিশ্বাস। এখানে যেমন কিছু স্বাধীনতা আছে, তেমনি ভুলের সম্ভাবনাও বর্তমান। ভুল না করে স্বাধীনতার সুযোগ গ্রহণে লেখকের ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে ক্ষমতা কতটা প্ৰকাশ পেয়েছে জানি না | পাত্ৰপাত্রীর উক্তিকে লেখকের মন্তব্য বলে গ্ৰহণ করা উচিত নয়। সে-সব উক্তি পাত্রপাত্রীর চরিত্রের সীমানার মধ্যেই সত্য, তাদের সত্যের সাধারণ রূপ বলে গ্ৰহণ করলে লেখকের প্রতি অবিচার করা হয়। বলা বাহুল্য, কোন ধর্ম কোন সম্প্রদায় বা কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তিকে আঘাত দেওয়ার উদ্দেশ্য এ গ্রন্থের নয়। তার চেয়ে উচ্চতর আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে লেখক। একটা সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পর্বের কয়েকটি বিশেষ নরনারীর সুখদুঃখের লীলাকে অবলম্বন করে নির্বিশেষ মানবসমাজের সুখদুঃখের লীলাকে অঙ্কন লেখকের উদ্দেশ্য। সে উদ্দেশ্য সফল হয়েছে এমন দাবি করি নাকিন্তু উদ্দেশ্য ও ছাড়া আর কিছু নয়। আরও একটা কথা বুঝলাম বিষয়ে প্রবেশ করে আর কাহিনীটা লিখতে গিয়ে— কলকাতা শহরের প্রাচীন অংশের প্রত্যেক পথঘাট, অট্টালিকা, উদ্যান, প্রত্যেক ইষ্টকখণ্ড বিচিত্ৰ কাহিনীরসে অভিষিক্ত । এ শহরের একটি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আছে যা ভারতের প্রাচীন শহরগুলোর ব্যক্তিত্ব থেকে স্বতন্ত্র। ভারতের প্রাচীন ও নবীন যুগের সীমান্তে অবস্থিত এই শহর। এর অনেক ক্রুটি সত্ত্বেও না ভালবেসে পারা যায় না। একে, কারণ এ আমার সমকালীন । সমকালীনতার দাবি এ শহরের সকলের প্রতি। “কেরী সাহেবের মুন্সী'রও ঐ দাবি-তদধিক কোন ঐশ্বর্য এর আছে মনে হয় না।


গোলকধাঁধায় সেনাপতি

জেনারেল সিমন বলিভার, দক্ষিণ আমেরিকার পাঁচটি দেশের ‘মুক্তিদাতা’ ম্যাগডালেনা নদীর ভাটিতে বিষাদময় শেষ ভ্রমণটির সময় পুনর্দশন করেছেন নদী তীরের শহর গুলো এবং হাতড়ে ফিরেছেন তার জীবনের সাফল্য, অনুরাগ ,উৎসাহ, ঘৃণা ও ক্রোধের তীব্র অনুভূতি এবং বিশ্বাসঘাতকতার স্মৃতিগুলো। অপরিমেয় মনোমুগ্ধকর , অত্যাশ্চর্যরুপে সফল যুদ্ধ, প্রেম এবং রাজনীতিতে; তখনও পর্যন্ত তিনি এতটাই উৎসাহ আর দক্ষতার সাথে নাচছিলেন যে প্রত্যক্ষদর্শীরা বিশ্বাস করতে পারছিলনা তিনি অসুস্থ।তিনিই ছিলেন যে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক সেটার বহ্নিমান স্মৃতি এবং তার মহদেশীয় একতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নটি সুকৌশলে এড়িয়ে চলছিল তাকে, কত বেশি অর্জন আর হারানোর যায় এক জীবনে - তিনি হচ্ছেন তারই চলমান দৃষ্টান্ত।


পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস ১ম খণ্ড

থেলিসের দর্শন দিয়েই দর্শনের যাত্রা শুরু। আমরা সৌভাগ্যবান যে তার সময়কাল | নির্ধারণ করতে পেরেছি। জ্যোতির্বিদদের মতানুসারে খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৫ অব্দে একটি সূর্যগ্রহণ হয়। থেলিসই এই সূর্যগ্রহণের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। মূলত শুরু থেকেই দর্শন ও বিজ্ঞান পরস্পর থেকে পৃথক ছিল না। তাই আমরা বলতে পারি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের শুরুতে দর্শন এবং বিজ্ঞানের একত্রেই জন্ম হয়। গ্রিস দেশে এবং প্রতিবেশী দেশসমূহে এর পূর্বে কী ঘটেছিল? এর যেকোনাে উত্তর হবে অংশত অনুমানমূলক, কিন্তু বর্তমানকালের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা আমাদের পিতামহের তুলনায় অধিকতর জ্ঞান প্রদান করেছে।


ফোকলোর ও লিখিত জারিগানের আসরে বিষাদ-সিন্ধু আত্তীকরণ ও পরিবেশন পদ্ধতি

ফোকলোর সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা প্রচলিত আছে- ফোকলোর কেবল নিরক্ষর লোকের সংস্কৃতি এবং এর সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও শিক্ষিতদের শিল্পভুবনের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। সম্ভবত এসব বদ্ধমূল ধারণার কারণে এদেশে ফোকলোরের সাথে লেখ্য-ঐতিহ্য, এমনকি লিখিত সাহিত্যের সম্পর্ক বিচার বিষয়ে বিশ্লেষণ বা আলোচনা-সমালোচনা চোখে পড়ে না। অথচ একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জগৎ জুড়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রসারে ফোকলোরের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিতদের সৃষ্ট বহু উপাদান তথা কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস ইত্যাদি ফোকলোরে আত্তীকৃত হয়ে থাকে। ফোকলোর ও লিখিত সাহিত্য : জারিগানের আসরে ‘বিষাদ-সিন্ধু’ আত্তীকরণ ও পরিবেশ-পদ্ধতি শীর্ষক গ্রন্থটি জনসমাজে চর্চিত সেই ধারাকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে বৃহত্তর পাঠকের সামনে উপস্থাপন করছে। গ্রন্থটি প্রথম অধ্যায়ে ফোকলোর সম্পর্কে বৈশ্বিক ধারণার সঙ্গে বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার ঐতিহ্যকে উপস্থাপিত হয়েছে, যা যথার্থভাবেই প্রমাণ করছে-বাংলাদেশের ফোকলোর যথেষ্ট অভিনবত্বের অধিকারী।


উড়ন্ত সব জোকার

মনভাল’র থেকে যেসব কবিতা লেখা হয় তারা অনেকটা বাড়ির ছােট মেয়ের মতাে। ফর্সা, চুল ছােট করে ছাটা, আদরের, গানের ক্লাসে যাওয়া ফুটফুটে। একটা মেয়ে। মন খারাপের থেকে যে-সমস্ত কবিতা উঠে আসে তারা বাড়ির বড় মেয়ের মতাে। চাপা রং, চুলঠোটনখে অযত্ন, দু’বার পাত্রপক্ষ ফিরে যাওয়া, সেলাইফোঁড়াই জানা একটা মেয়ে। আমি শুধু চেয়েছিলাম এই দুই বােনের মধ্যে রােগাসােগা, একরােখা, বদমেজাজি একটা ছেলে, যে অনেক রাত অব্দি গান শােনে, আর যার বন্ধু নেই কোনাে।