তাকে খতম করার জন্য অর্থাৎ তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরি করার জন্য ওরা এখানে এসেছে। এই জেলাশাসকের কৃতকর্মের জন্য মেদিনীপুরের স্বাধীনচেতা দামাল ছেলেদের আদালতে, অনেক আগেই তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। সেটাও জানতে পেরে, প্রাণ বাঁচাতে অতি গােপনে রাতের অন্ধকারে বাংলা থেকে বদলি হয়ে, বিহারের মজফরপুর এসেছে। কাপুরুষরা জানে না যে, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিচারের শাস্তি ওকে পেতেই হবে। হাকিম নড়বে তাে হুকুম নড়বে না। তাই হুকুম বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে, প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম, মজফরপুর এসে, সবকিছু ঠিকঠাক মতাে দেখে নিচ্ছে। জেলাশাসক কিংসফোর্ড কোন্ রাস্তায় অফিসে যায় কখন যায়, কখন ফেরে। কোন গাড়িতে, কোন রাস্তায় যায়।
আমি রামগড় থেকে ঘুরতে ঘুরতে পুরুলিয়ার দিকে আসছিলাম। ধরে নাও চাস রােডেই কোথাও সেই বাংলােটা। আশেপাশে কোনাে শহর নেই—বাংলােটা বলতে গেলে জনশূন্য মাঠের মধ্যে। তখনও ওসব জায়গায় ইলেকট্রিক যায় নি। এখনও গেছে কিনা আমি জানি না। ডাকবাংলােটা নতুন তৈরি হয়েছে, বেশ ছিমছাম চেহারা। আমি সেখানেই সে রাতের জন্য বসতি নেবাে ঠিক করলুম।
উপেন্দ্র আর কোন প্রশ্ন না করিয়াই রাজী হইলেন। এটা তাহার অভ্যাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলি এতই ভাল করিয়া পাশ করিয়াছিলেন যে, ছাত্রমহলে তাহার শ্রদ্ধা ও সম্মানের অবধি ছিল না। ইহা তিনি জানিতেন। তাই, কাজে-কর্মে, আপদে-বিপদে তাহারা যখনই আসিয়া পড়িয়াছে, তাহাদের আবেদন ও উপবােধকে মমতায় কোনদিন উপেক্ষা করিয়া ফিরাইতে পারেন নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সরস্বতীকে ডিজাইয়া আদালতের লক্ষ্মীর সেবায় নিযুক্ত হইবার পরও ছেলেদের জিমন্যাস্টিকের আখড়া হইতে ফুটবল, ক্রিকেট ও ডিবেটিং ক্লাবের সেই উঁচু স্থানটিতে গিয়া পূর্বের মত তাহাকে বসিতে হইত।
কেউ বলেন, তিনি বিষন্নতার কবি, আবার কেউ তার লেখনীর মধ্যে এক অতীন্দ্রিয় জীবনবােধের সন্ধান করেছেন। কেউ বলেছেন, জীবনানন্দ মানে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের মেলবন্ধন। কোনাে কোনাে উন্নাসিক সমালােচক আবার জীবনানন্দীয় কবিতাকে দুর্বোধ্য আখ্যা দিয়েছেন। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে যে, জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতায় এমন একটি নাম, যা রবীন্দ্রনাথের পর নির্দ্বিধায় স্মরণযােগ্য। এই যােগ্যতাকে আমরা কীসের নিরিখে পরিমাপ করব? মনে প্রশ্ন জাগে, কবিদের কবিত্বশক্তির বিচার কি এই ভাবে যােগ্যতার মাপকাঠিতে নির্ণীত হতে পারে? রবীন্দ্রনাথের মতাে জীবনানন্দও ছিলেন স্বতন্ত্র প্রতিভার অধিকারী। জীবনানন্দীয় কবিতা বিচার বিশ্লেষণ করতে হলে তার সময় এবং তার যুগকে অনুভব করা উচিত।
নববর্ষ মানে ক্যালেন্ডারের ছড়াছড়ি। তাদের কত না রূপ, কত বিচিত্র ধরন। যেমন, চোঙের ভেতর পাকিয়ে রাখা দেওয়াল ক্যালেন্ডারগুলাে; সেগুলােকে খুলে সােজা করে দেওয়ালে ঝােলানাের পরও পাকানাে ভাবটা থেকেই যায়, তারা যেন তাদের চোঙের ভেতরকার জীবনের স্মৃতিটা ভুলতেই চায় না! আবার দেখুন, টেবিল ক্যালেন্ডারগুলাের চেহারা, সুন্দর সুন্দর ছবিতে ভর্তি, কিন্তু তাতে তারিখগুলাে খুঁজে পাওয়া মুশকিল, সব ছবিতে ঢাকা। আর যে বস্তুটিতে রাখার জন্য তাদের নামকরণ টেবিল ক্যালেন্ডার, সেটাতে কী ঝামেলা করেই না তাদের বসাতে হয়।
ছদ কাকে বলে অথবা ছন্দের বিশ্লেষণ করা যায় কীভাবে, বাংলা ছন্দের কটা ধরণ আর কী বা তাদের পরিচয় – এসব নিয়ে এখনও অনেক লেখা সম্ভব, অনেকে লিখেছে তা। কিন্তু এ বইয়ের উদ্দেশ্য একটু ভিন্ন। কবির ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তার ব্যবহৃত ছন্দের যােগ কোথায়, কীভাবে কোনাে কবি অল্পে অল্পে খুঁজে নেন তার নিজের ছদ, অথবা কীভাবে কোনাে ছদ যেন খুলে যায় এক মুক্তির দিকে, এই নিয়েই ছিল আমার নানা সময়ের ভাবনা।
‘ভবঘুরে শাস্ত্র’ লেখার প্রয়ােজনীয়তা আমি অনেক দিন থেকে অনুভব করছিলাম। আমার মনে হয় অন্যান্য সমধর্মী বন্ধুরাও এর প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করছিলেন। ভবঘুরেমির অঙ্কুর জাগানাে এই শাস্ত্রের কাজ নয়; বরং যে অঙ্কুর মাথা তুলেছে তার পুষ্টি ও পরিবর্ধন তথা পথ প্রদর্শন এ বইয়ের লক্ষ্য। ভবঘুরের পক্ষে উপযােগী সমস্ত কথা সূক্ষ্ম রূপে এখানে এসে গিয়েছে, এমন কথা বলা উচিত হবে না, কিন্তু যদি আমার ভবঘুরে বন্ধুরা তাদের জিজ্ঞাসা ও অভিজ্ঞতার দ্বারা সাহায্য করেন, তাহলে আশা করি, পরের সংস্করণে এর অপূর্ণতা অনেকটা দূর করা যাবে।
এ-ভাবেই একের পর এক করে, বিভিন্ন সুযােগ-সুবিধায় সমৃদ্ধ হয়ে রকমারী ক্যামেরা হাজির হতে লাগলাে, তার সঙ্গে-সঙ্গে চাহিদাও বৃদ্ধি পেলাে আগ্রহশীল ফটোগ্রাফারদের আকাঙক্ষা মেটাতে। বহু কাজের সহায়ক হয়ে ফটোগ্রাফি একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে নিলাে অতি সহজেই। আজও সেভাবেই প্রচেষ্টা চলেছে নানা কাজের উপযােগী করে বিভিন্ন রকমের ক্যামেরা প্রস্তুত করার।
ক্রিস্টি কলম ছুঁয়েছেন আজ একশাে বছর হয়ে গেল, কিন্তু তার নির্যাসে আজও আমরা অর্থাৎ রহস্য পি সমধিক রােমাঞ্চিত হয়ে চলেছি। তার প্রতিটি সৃষ্টি আজও আমাদের চোখের সামনে চির নতুন হয়ে ধরা দেয়, আজকের জীবনের পটভূমিকাতেও। ধ্রুপদী সাহিত্যের এই গুনই সময়ান্তরে তাঁকে চিরকাল সমাদৃত করে রাখবে পাঠকের কাছে।
আজকের খবরের কাগজে কোনাে চাকরির বিজ্ঞাপন নেই। অর্জুন কাগজটাকে ভাঁজ করে আকাশের দিকে তাকাতেই যেন বুড়িদিকে দেখতে পেল। দু’বছর আগেও এই জলপাইগুড়ি শহরে বুড়িদির মতাে ফরসা সুন্দরী বােধহয় কেউ ছিল না। এমন রঙ ছবিতেও দেখা যায় না। তারপর কী হল কে জানে, বুড়িদির মুখে কালাে ছােপ জমতে লাগল। এখন সেগুলােয় ছেয়ে গেছে মুখ, তবু ফাঁকে ফাঁকে ফরসা চামড়াটাকে বােঝা যায়। কিন্তু সেটাই যে অস্বস্তির। এই দুপুরের আকাশটা যেন অবিকল বুড়িদি, সারা মুখে মেঘের মেচেতা নিয়ে বসে আছে।
রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য দীর্ঘদিন লাভ করিয়াছেন, বাংলা সাহিত্যের লেখকদের মধ্যে এমন সংখ্যা বেশি নয়। এই প্রসঙ্গে শ্ৰীপ্ৰমথনাথ বিশীর পর একমাত্র সৈয়দ মুজতবা আলীর নামই করা যায়। সৈয়দ মুজতবা আলীর নিকট একটি পূর্ণাঙ্গ কবিস্মৃতি লিখিবার অনুরোধ আমরা অনেকবার করিয়াছিলাম। লিখিবার বাসনাও তাঁহার হইয়াছিল। কতকটা সময়াভাব ও কতকটা আলস্যবশত শেষ পর্যন্ত তাহা হইয়া ওঠে নাই, যদিও তিনি বলিতেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে বিভিন্ন স্থানে প্রবন্ধে যাহা লিখিয়াছেন তাহা সাজাইয়া সম্পাদন করিয়া একটি পূর্ণাঙ্গ স্মৃতি-গ্রন্থের রূপ দেওয়া বিশেষ আয়াসসাধ্য নয়। “গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থটির প্রকাশ তাহার সেই অপূর্ণ বাসনা পরিপূরণের একটি প্রয়াস মাত্র। এই গ্রন্থ সংকলন কালে “গুরুদেব” নামক প্রথম অংশে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্ৰ-সাহিত্য সম্পর্কিত রচনাগুলি সংকলিত হইয়াছে। শান্তিনিকেতন আশ্রম ও অন্যান্য আশ্রম-সতীর্থদের সম্বন্ধে মূল্যবান রচনাগুলি অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে “শান্তিনিকেতন’ নামক দ্বিতীয় অংশে। ‘গুরুদেব’ অংশের রচনাগুলির বিস্তৃত পরিচয় গ্রন্থ-পরিচয়ে দেওয়া হইয়াছে। গ্রন্থের দুই অংশেরই রচনাগুলি ঘটনা-পরম্পর্য ক্রম অনুসারে সাজানো হইয়াছে। ত্রুটিবিচূতি থাকিলেও থাকিতে পারে। সহৃদয় পাঠক কেহ সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করিলে বাধিত হইব।