আরেক বার তিন জনে ছাদ-ফাটানাে হাসি হেসে দাবা খেলতে বসলেন। অর্থাৎ ভাষাবিদ ও দার্শনিক বসলেন, নাট্যকার দাঁড়িয়ে চুরুট ধরিয়ে অযাচিত মাতব্বরি করতে উদ্যত হলেন। কালীকান্ত অপমান বােধ করলেন, কিন্তু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারলেন না, কারণ একটু পরে চা-স্যান্ডুই আসবে। তাই ঝগড়ায় মাতবেন স্থির করে চেঁচিয়ে বললেন—কোথায় ভুল? - এ লেখার কোথায় ভুল দেখান দিকি ?
খুব ভাের ইনডাের সুইমিং পুলের ধারে তিনি এসে দাঁড়ালেন, মুখে হাসি নেই, গাম্ভীর্যও নয়, একটু চিন্তিত বােধ হয়, প্যান্টের দু পকেটে হাত, কাঁধটা একটু উঁচুতে তােলা, দু পা পরস্পরের সঙ্গে কাটাকুটি করা, গায়ে সাদাকালাে একটা ব্যানলনের গেঞ্জি। নিথর জলে তার ছায়া পড়েছে। একটু ঝুঁকলেই নিজের ছায়া তিনি দেখতে পারেন। কিন্তু গত বিশ বাইশ বছর ধরে তিনি পৃথিবীর হাজারাে পত্রপত্রিকায়, পােস্টারে, চলচ্চিত্রে বা টেলিভিশনে নিজের এত ছবি দেখেছেন যে নিজের ছায়া বা প্রতিবিম্ব দেখতে তাঁর আর কোনাে ইচ্ছেই হয় না। সারাটা জীবন তাঁকে তাড়া করছে হাজারাে ক্যামেরা, ফ্ল্যাশ লাইট, হাজারাে সাক্ষাৎকার, লক্ষ লক্ষ লােকের জয়ধ্বনি, স্তুতি ও ভালবাসা।
“অদ্য আমাদিগের কি শুভ দিন। অদ্য আমরা যত অরণ্যবাসী মাংসাভিলাষী ব্যাকুলতিলক সকল পরস্পরের মঙ্গল সাধনাৰ্থ এই অরণ্যমধ্যে একত্রিত হইয়াছি। আহা! কুৎসাকারী, খলস্বভাব অন্যান্য পশুবর্গে রটনা করিয়া থাকে যে, আমরা বড় অসামাজিক, একা এক বনেই বাস করিতে ভালবাসি, আমাদের মধ্যে ঐক্য নাই। কিন্তু অদ্য আমরা সমস্ত সুসভ্য ব্যাঘ্ৰমণ্ডলী একত্রিত হইয়া সেই অমূলক নিন্দাবাদের নিরাস করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি! এক্ষণে সভ্যতার যেরূপ দিন দিন শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে, তাহাতে আমার সম্পূর্ণ আশা আছে যে, শীঘ্রই ব্যাঘ্রেরা সভ্যজাতির অগ্রগণ্য হইয়া উঠিবে। এক্ষণে বিধাতার নিকট প্রার্থনা করি যে, আপনারা দিন দিন এইরূপ জাতিহিতৈষিতা প্রকাশপূর্বক পরম সুখে নানাবিধ পশুহনন করিতে থাকুন।”
বঙ্কিমচন্দ্রের বয়স যখন আটচল্লিশ বৎসর, তখন তাহার কৃষ্ণ-চরিত্র’ পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়, এবং সেই সময়ে প্রচারে’ তিনি গীতার ব্যাখ্যা লিখিতে প্রবৃত্ত হন। কৃষ্ণ-চরিত্রের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে তিনি লিখিয়াছেন-“আমার দুরাকাঙ্ক্ষা যে, শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যেও কেই কেহ এই গ্রন্থ পাঠ করেন। তাই আমি ইউরােপীয় মতেরও প্রতিবাদে প্রবৃত্ত। যাঁহাদের কাছে বিলাতী সবই ভাল, যাঁহারা ইস্তক বিলাতী পণ্ডিত, লাগায়েৎ বিলাতী কুকুর, সকলেরই সেবা করেন, দেশীগ্রন্থ পড়া দূরে থাক, দেশী ভিখারীকেও ভিক্ষা দেন না, তাহাদের আমি কিছু করিতে পারিব - না। কিন্তু শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকেই সত্যপ্রিয় এবং দেশবৎসল। তাহাদের জন্য লিখিব।” বলা বাহুল্য, এই শ্রেণীর শিক্ষিত সম্প্রদায়ের জন্যই তিনি ধর্মতত্ত্ব’ লিখিয়াছিলেন এবং গীতার ব্যাখ্যা লিখিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। কিন্তু দেশের দুর্ভাগ্য যে, সে ব্যাখ্যা তিনি আর শেষ করিয়া যাইতে পারেন নাই।
ঝক করে টর্চের ফোকাসটা মেরেই নিরাপদ বলল, আরিব্বাস! এ যে লহরী খেলছে। নেলাে একটু পেছনে। এক হাতে গরুর দড়ি, অন্য হাতে ভরা থলি। গরুটা একটু পিছনে দাঁড়ানাে। নেলাে বলল, কাপড়খানা খুলে গামছাখানা পরে নেন। এ হল ভাসি গাঁয়ের জলা। তলায় তলায় ইছামতীর সঙ্গে যােগ আছে। বর্ষার ইছামতীর জল বাড়লে এই জলা একেবারে তল। ঘুরপথ নেই? তা থাকবে না কেন? পিছনবাগে চার মাইল গিয়ে দক্ষিণের রাস্তা ধরে গেলে পাক্কা পাঁচ ক্রোশ। তা সে রাস্তাও আপনার মনের মতাে হবে না। হরেদরে কাশ্যপ গােত্র। এই রাস্তায় বরং সুবিধে আছে। নিরাপদ খ্যাক করে উঠল, সুবিধে! সুবিধেটা কী দেখছ? জলার ভিতর দিয়ে ছাড়া কি আর পথ ছিল না?
ইতিহাস যদি নাটক হয় তবে ভূগােল তার মঞ্চ। ইতিহাস, রাজনীতি এমনকি ভ্রমণ কাহিনী। পাঠেও সঠিক উপলব্ধি হয় না যদি না যে দেশ বা মহাদেশ নিয়ে আলােচনা সে সম্পর্কে। পাঠকের সঠিক সুস্পষ্ট ধারণা থাকে। তাছাড়া স্কুল কলেজে ভূগােল পড়তে হয়, জানতে হয় সূর্য তারা, গ্রহ উপগ্রহ থেকে শুরু করে পৃথিবীর সাগর উপসাগর, নদী, হ্রদ, পাহাড়, আগ্নেয়গিরি, মহাদেশ দেশ নগর জনপদের কথা, খনিজ পদার্থ ও বাণিজ্যিক তথ্য সম্পর্কিত অনেক কিছু। কিন্তু এমন অভিধান বাংলা ভাষায় ছিল না যাতে বর্ণানুক্রমে উল্লেখিত সব তথ্য সবিস্তার জানা যায়।
সে বলে, ঈশ্বর আছেন, আমি আছি। ঈশ্বর সত্যই আছেন, আমি আছি কি না সেটাও ঈশ্বর জানেন। আমি জানি ঈশ্বর আছেন, তাই আমিও আছি। নইলে কী করে জানব ঈশ্বর আছেন? এটা অতি সােজা কথা। পাত্ৰাধার তৈল কি তৈলাধার পাত্র—সে ইয়ার্কি নয়! সহজ সরল কথা। আমি আছি কি নেই? এটা জানেন ঈশ্বর। বেশ কথা। ঈশ্বর কী জানেন বা না জানেন সে প্রশ্নই ওঠে । তিনি সব জানেন—আবার কিছুই জানেন না। তিনি অনন্ত কিন্তু সৃষ্টি করেন—আবার অনন্তশয্যায় অনন্ত ঘুমে ঘুমিয়ে থাকেন। কাজেই হিসাবটা ওদিক দিয়ে নয়। ঈশ্বর আছেন আমি এটা জানি। সেটাই প্রমাণ যে ঈশ্বরও জানেন আমি আছি। আমি যদি না থাকব তবে কী করে জানব একমাত্র ঈশ্বরই জানেন আমি আছি কি নেই? কাজেই আমি আছি।
আমি যে সময়ের কথা বলছি সেসময় রাজেশ খন্না খুব নামী একজন হিরাে। তার মতাে জামার উপর বেল্ট পরা আর-একদিকে কান্নিক মেরে হাঁটা ফ্যাশন। সেসময় পেট মােটা ফোলা-ফোলা মােটর গাড়ি চলে শহরের রাস্তায় আর ছােট বােতলে হাফ সার্কল ফুল সার্কল কোলা পাওয়া যায় দোকানে-দোকানে। আমি যে সময়ের কথা বলছি সেটা ১৯৭৪ সাল। আমার বয়স তখন সবে পনেরাে। মানে যে বয়সে মন আর গলা একসঙ্গে ভেঙে যায় আর কী!
বাইরের পৃথিবীর কাছে আমরা টিভিতে পনেরাে সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনে দেখানাের মতাে সুখী দম্পতি। বাবা, মা, দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখের সংসার আমাদের। নিখুঁত ছন্দে চলে আমাদের সংসার। ছবির মতাে সুন্দর অন্তর্সজ্জায় সাজানাে-গােছানাে ফ্ল্যাট। ফুটফুটে ছেলেমেয়েরা অবাধ্য নয়, পড়াশােনায় অমনােযােগী নয়, আমার বাবা-মাকে নিয়ে একই ছাদের তলায় থাকতে লােপর কোনও অসুবিধে নেই, মনােমালিন্য তেমন একটা হয় না। এমনকী, আমাদের কারও কোনও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কও নেই! অথচ আমরা নিজেরা জানি, ভিতরে ভিতরে নিস্তরঙ্গ শান্ত সম্পর্কের শৈত্য ক্রমশ আমাদের ধীরেধীরে একটা খাদের কিনারার দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।
অনিতা দিল্লির মেয়ে, বাংলা ও বাঙালি সম্পর্কে প্রবল কৌতূহল। রুইকে রহু বললে কী হবে, লেক মার্কেটে ওকে সবাই চেনে। মাছওয়ালাদের ফেভারিট বউদি। দেখলে কেউ বলতে পারবে না, এ বউদি যে-সে বউদি নয়, সদ্য দেশে ফেরা এনআরআই। বরং যে রবির জম্মকম্ম কলকাতায়, তার চেহারাতেই বিদেশি ছাপ বেশি। কথায় কথায় ইংরেজি। ভিখিরি দেখলে চোখ কটমট। মাছের বাজারে ঘেন্না ঘেন্না ভাব।
তারপর মিসেস কাপুর উপাসনাকে পরিচয় করিয়ে দেন অন্যান্য অফিসার ও তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে। পরিচয় পর্ব শেষ হতেই গ্রুপ ক্যাপ্টেন গলা চড়িয়ে বলেন, ফ্রেন্ড, কাম অন ; লেট আস হ্যাভ ড্রিকস্ ইন অনার অব উপাসনা অ্যান্ড সাকি। মিসেস কাপুর উপাসনাকে পদ্মিনী আর আমিনার কাছে নিয়েই বলেন, তােমাদের কোয়ার্টার এরা দু’জনে সাজিয়েছে ; তােমার পছন্দ হয়েছে তাে? উপাসনা ওদের দুজনকে জড়িয়ে ধরে খুশির হাসি হেসে বলে, কী বলে যে তােমাদের ধন্যবাদ জানাব, তা ভেবে পাচ্ছি না। কোয়ার্টার দেখে আমি অবাক হয়েছি ; আমি স্বপ্নেও ভাবিনি, কেউ আমাদের কোয়ার্টার এত সুন্দর : করে সাজিয়ে দেবে।
তবে স্যার, আপনি যদি ধর্ম বা জাতি ব্যাপারে বিশিষ্ট গোঁড়া হয়ে থাকেন, তা হলে রবীন্দ্র-উদ্ধৃতিটা অতিশয়ে দুর্বোধ্য মনে হবে। মনে হবে, এ আবার কী কথা! এ-ও হয় নাকি! একই বাপ-মায়ের ওইরকম খ্রিস্টান-হিন্দু-বৈষ্ণব-মুসলমান সন্তান। এই ফ্যামিলির তা হলে, গােড়াতেই বার্থ কন্ট্রোল্ড হওয়া উচিত। কিন্তু না স্যার। কথাটা রাম-রহিম কথিত উক্তি নয়, রামা শ্যামা-যদুমধুর বাক্যি নয়। ওটি ভেবেছেন মহামনীষী রবীন্দ্রনাথ, যার কথা আগামী হয়তাে সহস্র বছরে সত্য প্রতিপন্ন হবে। যে দিন আপনি-আমি থাকব না। কিন্তু মানবজাতি এই ভারতবর্ষে থেকে যাবে। ধর্ম হবে মানুষের নিতান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। মানুষের সভ্যতা সেই দিকেই এগগাচ্ছে। আপনার স্যার খারাপ লাগলেও, রবীন্দ্রনাথের কিছুই করার নেই।
সাংবাদিক হিসেবে রণেশের গুরুত্ব কতখানি সেটা অন্য বড় কাগজগুলাে খুব ভালাে করেই জানে। চার পাঁচ লাখের ওপর সার্কুলেশন, এমন দুটো কাগজ তাকে অফার দিয়ে রেখেছে যেদিন ইচ্ছে সে তাদের ওখানে জয়েন করতে পারে। তার জন্য সবসময় ওদের দরজা খােলা। দৈনিক প্রভাত’ তাকে যা দেয়, ওরা তার তিনগুণ মাইনে দেবে। সেই সঙ্গে সর্বক্ষণের গাড়ি। পার্ক, মেডিকেল অ্যালাওরেন্স, হাউস রেন্ট ইত্যাদি মিলিয়ে অঙ্কটা যা দাঁড়াবে তা মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতাে। তবু মাঝারি মাপের দৈনিক প্রভাত’কে ছেড়ে যেতে পারেনি সে। কারণটা হল আবেগ এবং কৃতজ্ঞতা।
সন্ধ্যায় দরজায় একটি টোকা পড়তে না পড়তেই দুটি উৎসুক হাতে দরজাটি খুলে যায় ; সারাদিনের পরিশ্রম-শ্রান্ত ছেলেটি ধীরে ধীরে গিয়ে পরিচ্ছন্ন বিছানায় একটু বসে, আপত্তি করে বলে, না গাে তােমায় জুতাের ফিতে খুলে দিতে হবে না। মেয়েটি প্রতিবাদ করে বলে, “তা দিলেই বা, তাতে দোষ কি? ছেলেটি একটু রাগ দেখিয়ে বলে, ওটা কি আমি নিজে পারিনে?...'মেয়েটি খুলতে খুলতে বলে, তা হােক, তুমি চুপ করাে দেখি।
অন্ধকার রাত। কাঁচামাটির রাস্তা। ধারের বড় বড় গাছগুলাের ঝাকড়া ডালপালা আকাশের তারার আলােকেও ঢেকে রেখেছে। তারই মধ্যে হাত তিনেক দূরে একটা দেশলাই এর আলােও রােশনাই বলে মনে হয়। ক্ষণিকের জন্যে রাত্রির সমস্ত অন্ধকার শুধু একটা মুখকে স্পষ্ট করে তােলবার পশ্চাদপট হয়ে উঠল। সে মুখ ভােলবার নয়।
ছােট জামাটা পরে পিঠের দিকে হাত ঘুরিয়ে হুকের নাগাল পাচ্ছিল না রতন। দুটো মাথা ধরে একটু টানাটানি করল। নাঃ, হচ্ছে না। ধুর-ধুর, এভাবে একা-একা কি হয়! সরস্বতীটা অন্যদিন থাকে। এই ছােট জামা, ব্লাউজ পরিয়ে দেওয়া, শাড়ির কুঁচি ঠিক করে দেওয়া, এই কাজগুলাে ওকে দিয়েই করায় রতন। কিন্তু আজ ওর শরীর খারাপ। গত মাসে প্রথম ঋতুমতী হল সরস্বতী। প্রথম-প্রথম ততা, পেটে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। একটু আগে দেখে এল বেচারি বিছানায় শুয়ে পেট চেপে ধরে কোঁকাচ্ছে। একটা কিছু ওষুধবিষুধ দিতে পারলে হত মেয়েটাকে। রতন কতবার বলেছে যে, দলে একটা কম্পাউন্ডার গােছের লােক রাখলে হয়। যে লােকটা ছােটখাটো জ্বরজারি, পেটখারাপ, ব্যথাবেদনায় ওষুধ দিতে পারবে। এমনিতেই দল নিয়ে চরকিপাক খেতে হয়। বছরের মধ্যে আট-ন’ মাসই এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গা ঘুরে বেড়ানাে।