এই শহরে ছােট বড় দ্বীপের মতাে কত যে ভূখণ্ড। কোনওটা চেনা, কোনওটা আধাে-চেনা, কোনওটা বা একেবারেই অচেনা। এইসব ভূখণ্ড নিয়ে বিশাল এক দ্বীপপুঞ্জ যার নাম কলকাতা মেট্রোপলিস। কর্পোরেশনের চৌহদ্দির দক্ষিণ সীমানা ঘেঁষে এমনই একটা দ্বীপ শহরের গায়ে আলগাভাবে জুড়ে আছে। কলকাতার মধ্যেই আছে আবার যেন নেইও। নিরানব্বই বছর আগে সেই ব্রিটিশ আমলে আদমশুমারিতে কলকাতার জনসংখ্যা যখন মেরেকেটে বারাে-চোদ্দো লাখ, সেই সময় বাঙালি খ্রিস্টানদের এই পাড়াটার পত্তন হয়েছিল। নামকরণ কর হয়েছিল ‘নিউল্যান্ড।
ইউনিক সেলিং পােপােজিশন। সেটা কী? না, ওই দাঁতের মাজনটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে এটা কেননা। তােমার বউ বায়না করবে যে, আমি এইটে, এই বিশেষ ধরনেরটাই কিনব। বায়না করবেই, কারণ, রূপা যখন হায়দ্রাবাদে ওর দিদির বাড়ি বেড়াতে গেছিল, এটা দিয়ে দাঁত মেজে মনে হয়েছে অনেক বেশি ঝকঝকে হাসি হাসছে ও। এই ঝকঝকে’ ব্যাপারটাই হল রূপার বায়না-করা টুথপেস্টের ইউ এস পি, যা অন্য পেস্টে নেই।
পরদিন খুঁজিয়া হ্যারিংটন স্ট্রীট বাহির করিলাম, বন্ধুর বাড়িও বাহির করিলাম। বাড়ি খুব বড় নয়, তবে সামনে পিছনে বাগান। গেটে উইস্টারিয়া লতা, নেপালী দারােয়ান ও পিতলের প্লেট। লাল সুরকির বাঁকা রাস্তা। রাস্তার এক ধারেসবুজ ঘাসের বন, অন্য ধারে বড়বড়মুচুকুন্দ চাপাও আমগাছ। গাড়িবারান্দায়বড় একখানা মােটর গাড়ি।বড়লােকের বাড়ি নয় বলিয়া ভুল করিবার কোন দিক হইতে কোন উপায় নাই। সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়াই বসিবার ঘর। অবিনাশ আসিয়া আদর করিয়া ঘরে বসাইল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পুরাতন দিনের কথাবার্তায় আমরা দুজনেই মশগুল হইয়া গেলাম। অবিনাশের বাবা ময়মনসিংহের একজন বড় জমিদার, কিন্তু সম্প্রতি কলিকাতার বাড়িতে তাহারা কেহই নাই। অবিনাশের এক ভগ্নীর বিবাহ উপলক্ষে গত অগ্রাহয়ণ মাসে দেশে গিয়াছিলেন- এখনও কেহই আসেন নাই।
ভয়ানক বর্ষা। ক’দিন সমানভাবে চলিয়াছে; বিরাম বিশ্রাম নাই। প্রতুল মেসের বাসায় নিজের সিটটিতে বসিয়া বসিয়া বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছে। কোথায় বা বাহির হইবে? যাইবার উপায় নাই কোনদিকে, ছাদ চুঁইয়া ঘরে জল পড়িতেছে—সকাল হইতে বিছানাটা একবার এদিকে, একবার ওদিকে সরাইয়াই বা কতক্ষণ পারা যায়? সন্ধ্যার সময় আরও জোর বর্ষা নামিল। চারিদিক ধোঁয়াকার হইয়া উঠিল, বৃষ্টির জলের কুয়াশার ফাকে ফাকে গ্যাসের আলােগুলা রাস্তার ধারে ঝাপসা দেখাইতেছে।
‘বিভূতিভূষণ গল্প সমগ্র’ বইয়ের সূচিপত্রঃ
* সিঁদুরচরণ-৭
* একটি কোঠাবাড়ীর ইতিহাস-১৫
* বুধোর মায়ের মৃত্যু-২২
* ছেলে ধরা-৩২
* রামতারণ চাটুজ্যে, অথর-৩৭
* নুটি মন্তর-৪৬
* ফড় খেলা-৫১
* হাট-৫৫
* অরণ্যকাব্য-৫৯
* মণি ডাক্তার-৬৭
* পুরোনো কথা-৭৫
* খোসগল্প-৭৯
* একটি দিনের কথা-৮৪
* বাটি-চচ্চড়ি-৯০
* ডাইনী-৯৩
* বুধীর বাড়ি ফেরা-৯৬
* বিধু মাস্টার- ১০৭
* উন্নতি-১১১
* কিন্নর দল-১১৬
* ননীবালা-১২৮
* বিরজা হোম ও তার বাধা-১৩৪
* বুড়ো হাজরা কথা কয়-১৩৯
* কাশী কবিরাজের গল্প-১৪৭
* ছোটনাগপুরের জঙ্গলে-১৫২
* মায়া-১৫৪
* আমার ডাক্তারি-১৬১
* বর্শেলের বিড়ম্বনা-১৬৮
* কাদা-১৭২
* ভৌতিক পালঙ্ক-১৭৭
* যদু হাজরা ও শিখিধ্বজ-১৮২
* জন্ম ও মৃত্যু-১৮৯
* সই-১৯৫
* রামশরণ দারোগার গল্প- ১৯৭
* খুড়িমা-২০১
* বায়ুরোগ-২০৯
* অরন্ধনের নিমন্ত্রণ-২১৩
* লেখক-২২৬
* বড়বাবুর বাহাদুরি-২৩০
* অন্নপ্রাশন-২৩৫
* তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প-২৪৩
* ডাকগাড়ী-২৫৬
* অকারণ-২৬৪
* দ্রবময়ীর কাশীবাস-২৬৬
* ক্যানভাসার কৃষ্ণলাল-২৮১
* পারমিট-২৯০
* মুক্তি-২৯৭
* গায়ে হলুদ-৩০৭
* ঠাকুরদর গল্প-৩১৩
* ভিড়-৩১৯
* আরক-৩২৩
* থিয়েটারের টিকিট-৩২৮
* পাথক্য-৩১৩
* স্বপ্ন-বাসুদেব-৩৩৩
* অসাধারণ-৩৪৮
* নদীর ধারের বাড়ী-৩৫৪
* বিপদ-৩৬১
* জন্মদিন-৩৬৭
* কাঠ বিক্রি বুড়ো-৩৭৩
* হারুণ অল রসিদের বিপদ-৩৭৬
* সুলেখা-৩৮০
* রূপো বাঙল-৩৮৫
* তেঁতুলতলার ঘাট-৩৮৯
* দুই দিন-৩৯৫
* মাকাল-লতার কাহিনী-৪০০
* বংশলতিকার সন্ধানে- ৪০৩
* কমপিটিশন-৪১১
* ব্ল্যাকমার্কেট দমন কর-৪১৭
* তুচ্ছ-৪২০
* পিদিমের নিচে-৪২২
* সংসার-৪৩২
* হিঙের কচুরি-৪৪০
* দুই দিন- ৪৫১
* অনুশোচনা-৪৫৬
* দাদু-৪৫৯
* বাসা-৪৬৮
* বন্দী-৪৭৪
* থনটন কাকা-৪৮০
* কালচিতি-৪৮৪
* দিবাবসান-৪৯১
* মুশকিল-৪৯৩
* গল্প নয়-৪৯৭
* কুশল পাহাড়ী-৫০০
* ঝগড়া-৫০৪
* বড় দিদিমা-৫১৬
* অবিশ্বাস্য –৫২২
* খেলা-৫২৫
* জাল-৫৩৩
* আবির্ভাব-৫৪১
* মানতালাও-৫৪৪
* বে-নিয়ম-৫৫০
* অভিমানী-৫৫৭
* শিকারী-৫৬৪
* পরিহাস-৫৬৮
* জওহরলাল ও গড্-৫৭২
* গল্পনয়-৫৬৭
* সীতনাথের বাড়ি ফেরা-৫৭৮
* হরিকাকা-৫৮৬
* পথিকের বন্ধু-৫৯৩
* এমনিই হয়-৫৯৭
* ঝড়ের রাতে-৬০৫
* আর্টিস্ট-৬১০
* শেষ লেখা-৬১৫
* ভণ্ডুলমামার বাড়ি-৬২৩
* পেয়ালা-৬৩১
* উইলের খেয়াল –৬৩৫
* কনে দেখা-৬৪৩
* সার্থকাতা-৬৪৮
* একটি দিন-৬৫৩
* বাইশ বছর-৬৫৫
* বৈদ্যনাথ-৬৫৯
* ডানপিটে-৬৬৪
* যাত্রাবদল-৬৭৪
* মরীচিকা-৬৮২
* আমার লেখা-৬৮৮
* রহস্য –৬৯২
* অশরীরী- ৬৯৬
* বিশ্ব-শিল্পী- ৭০২
* বনে-পাহাড়ে-৭০৪
পার্কটা কেমন নির্জন আর শান্ত না? শুধু গাছের পাতা নড়ার শব্দ আর পাখির ডাক। খানিক আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। ভেজা ভেজা বাতাস। গাছগাছালি জলে ধুয়ে ঝলমল করছে। দুপুরের আকাশ মেঘেভরা। মনে হয়, আরাে বৃষ্টি হবে। সময় আর পরিবেশটা প্রেমের গল্পের জন্য আইডিয়াল। আমি সুযােগটা ছাড়তে চাই না। নিচু গলায় ফিসফিস করে বলব। মাঝেমধ্যে একটু হাসব, বােকা ধরনের হাসি। সামান্য লজ্জাও পেতে পারি। লজ্জা পাব কেন? গল্পের শেষের দিকে একটা চুমুর ঘটনা আছে। সাতষট্টি বছর বয়েসে চুমুর কথা বলতে লজ্জা পাব না?
জমকালাে হােটেল বিল্ডিংটার দিকে ভালাে করে তাকিয়ে দেখলাে সুমনা। কতবার এখান দিয়ে যাওয়া-আসা করেছে। সেভাবে লক্ষ্য করে নি। পার্ক স্ট্রিট মানেই ভালাে ভালাে হােটেল, রেস্তোরাঁ। উল্টোদিকের ফুটপাত থেকে এখন দেখছে, কেননা এটাই তার নতুন কর্মক্ষেত্র। সাধারণ একটা অ্যাড ফার্ম থেকে এই যে লিফ্টটা ও পেলাে, এটা ভাগ্য বলতে হবে। এই চাকরিটার দৌলতে এখন থেকে সে মিসেস রডরিগস-এর গেস্ট হাউজে একটা পুরাে স্যুইট নিয়ে থাকতে পারবে। শােবার ঘর, বসবার লাউঞ্জ, সেখানেই কিচেন আর টয়লেট। ইচ্ছে করলে এখনও মিসেস রডরি-এর কাছে খাওয়ার বন্দোবস্তটা রাখতেই পারে। ইচ্ছে করবে কিনা সেটা একটু ভাবতে হবে। কদিন গেলে বলা যাচ্ছে না। শিফ্ট ডিউটি করে তাে অভ্যেস নেই! যে শিটে কাজ করবে সেই শিটের সময়ে লাঞ্চ বা ডিনার হােটেলেই পাবে। ব্যবস্থাটা তার পক্ষে সুবিধের। খানিকটা টাকা জমিয়ে নিয়ে হােটেল ম্যানেজমেন্টের একটা কোর্স করে নেবার খুব ইচ্ছে আছে।
“মেঘমল্লার” বইয়ের সূচীপত্র:
* মেঘমল্লার
* নাস্তিক
* উমারাণী
* বউ চণ্ডীর মাঠ
* নব বৃন্দাবন
* অভিশপ্ত
* খুকীর কাণ্ড
* ঠেলা গাড়ি
* পুঁই মাচা
* উপেক্ষিতা
বহুদিন হইতে তাহার ঠেলাগাড়িতে চড়িয়া হাওয়া খাইবার শখ হইয়াছে, কিন্তু কিছুতেই তাহা মিটিবার উপায় হইতেছে না। ছয় বৎসরের এক নাতিনি আসিয়া। সরােদনে কহিল, পূজার নিমন্ত্রণে যাইবার মতাে তাহার একখানিও ভালাে কাপড় নাই। রামসুন্দর তাহা জানিতেন, এবং সে-সম্বন্ধে তামাক খাইতে খাইতে বৃদ্ধ অনেক চিন্তা করিয়াছেন। রায়বাহাদুরের বাড়ি যখন পূজার নিমন্ত্রণ হইবে তখন তাঁহার বধূগণকে অতি যৎসামান্য অলংকারে অনুগ্রহপত্র দরিদ্রের মতাে যাইতে হইবে, এ কথা স্মরণ করিয়া তিনি অনেক দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়াছেন; কিন্তু তাহাতে তাহার ললাটের বার্ধক্যরেখা গভীরতর অঙ্কিত হওয়া ছাড়া আর-কোনাে ফল হয় নাই।
বিপুলের ডাকনাম পানু। তার খালি তিন বােন—সানু, মানু, ভানু। বিপুল কোন কথা বলল না। বন্ধুনাথ নিজের নিশ্ৰুপ ছেলেকে দেখছিল। এই ঠিক সাড়ে আট বছর বয়স বিদ্যুতের। তার নিজের এখন একচল্লিশ। হাফ-প্যান্টের বাইরে ছেলের দুখানা পা ডগডগাননা লাউডগা হয়ে বেড়ে উঠেছে। ওপরের দিকের চেয়ে নিচের দিকটাই বেশি লম্বা বিপুলের। খেলাধুলােয় দুটো হাঁটুই ছড়ে গেছে ছেলের। বন্ধুনাথ আবার বলল, ট্রেন থেকে নেমে জায়গাটা চিনতে পারবি তাে?
এই নিষ্ঠুর অভিযােগে গফুরের যেন বারােধ হইয়া গেল। ক্ষণেক পরে ধীরে ধীরে কহিল, কাহন-খানেক খড় এবার ভাগে পেয়েছিলাম, কিন্তু গেল সনের বকেয়া বলে কর্তামশায় সব ধরে রাখলেন। কেঁদেকেটে হাতেপায়ে পড়ে বললাম, বাবুমশাই, হাকিম তুমি, তােমার রাজত্বি ছেড়ে আর পালাবাে কোথায়, আমাকে পণ-দশেক বিচুলিও না হয় দাও। চালে খড় নেই—একখানি ঘর, বাপ-বেটিতে থাকি, তাও না হয় তালপাতার গোঁজা-গাঁজা দিয়ে এ বর্ষাটা কাটিয়ে দেব, কিন্তু, না খেতে পেয়ে আমার মহেশ মরে যাবে।
বােবা-বােবা চেহারার বাড়ি। ছােট ছােট ফোকরচোখ জানলা আর চুনখসা খিলানের হাঁ। টুল-পাতা রেস্তোরাঁর সদাব্রত, সাজো-বাসি ধােবাখানা, তারপর, কী আশ্চর্য, তারপর একটা পার্ক। মরা ঘাস, ভাঙা রেলিং, কাঠা দুই জমি, তবু তাে পার্ক। রুদ্ধশ্বাস ইটকাঠের মধ্যে একটুখানি অক্সিজেনের আশ্বাস। আরও খানিক এগিয়ে, দু-তিনটে মােড় ঘুরে, তবে কিনু গােয়ালার গলি। পাশাপাশি চারটে শরীর গলে কি গলে না এমন গলি। এ-রাস্তা মোেটরের মুখ দেখেনি, ট্রাম-বাসের ক্ষীণতম ঘর্ঘরও পার্ক পর্যন্ত এসে মিলিয়ে গেছে; ছ্যাকড়া গাড়িও ঢুকতে চায় না। কখনও সখনও দু-একটা রিকশা ঢােকে, ঢুকেই পালাই-পালাই করে।
লুইস ব্রাউনের পিতামহ কাজ করতেন অসমের চা বাগানে। পিতামহকে সে দেখেনি। তার জন্মের আগেই তিনি মারা যান। পিতামহী স্থায়ীভাবে কখনােই অসমে থাকেননি। লন্ডনের বাড়িতেই থাকতেন। জীবনে দু’বার তিনি স্বামীর কাছে। এসেছিলেন বেড়াতে। বেশিদিন থাকতে পারেন নি। স্বামীর প্রতি ভালােবাসা যে তাঁর ছিল না, তা নয়। কিন্তু অসমের জঙ্গল, মশা, ম্যালেরিয়া সর্বোপরি এই নির্বাসিত জীবন তাকে টানেনি। ফিরে গেছেন নিজের দেশে। পিতামহ বছরে দুই বছরে কয়েক দিনের ছুটিতে দেশে যেতেন। স্বামী-স্ত্রীতে দেখা সাক্ষাৎ, সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া যা কিছু সব তখনই হত।
ডুডুয়া একটি নদীর নাম। পাহাড়ি ঝরনাগুলাে মিলে মিশে সমতলে পৌঁছে নদীর চেহারা নেয়, এ নদীও নিয়েছিল। নিয়ে মাইল তিরিশেক গিয়ে সব জল ঢেলেছে জলঢাকার পেটে। অতএব নদীর দৈর্ঘ্য বেশি নয়। তবে এর জল শীত গ্রীষ্মে কমে গেলেও একেবারে শুকোয় না। তখন বেশ শান্ত বালিকার মতাে তিরতিরিয়ে বয়ে যায়। ওইটুকু যাওয়ার পথে তাকে একবারই মাথার ওপর সেতুকে মেনে নিতে হয়েছে।