চন্দ্রা নদী তীর ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে এসে পলাশপুর গ্রামের বড় হিজল গাছটা পর্যন্ত এসে হঠাৎ করে থেমে গেল। হিজল গাছটার অর্ধেক তখন শুন্যে নদীর কালাে পানির উপর ঝুলছে, বাকী অর্ধেক কোন ভাবে মাটি কামড়ে আটকে আছে- দেখে মনে হয় যে কোন মুহূর্তে পুরাে গাছটা বুঝি পানিতে হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়বে। এই গাছটা ছিল পলাশপুর গ্রামের বাচ্চা কাচ্চাদের সবচেয়ে প্রিয় গাছ। তারা এর মােটা ডাল বেয়ে উপরে উঠত, মাঝারী ডালগুলিতে ঘােড়ার মত চেপে বসে দুলত, সরু ডালগুলি ধরে ঝুল খেয়ে নিচে লাফিয়ে নামত। নদীর ভাঙ্গনের মাঝে পড়ে যাওয়ায় প্রথম প্রথম বাচ্চারা কেউ এই গাছে উঠতে সাহস করত না। এক দুই দিন যাবার পর গ্রামের দুর্দান্ত আর ডানপিটে কয়েকজন একটু একটু করে গাছটায় আবার ওঠা শুরু করল, কিন্তু ঠিক তখন জমিলা বুড়ী একদিন নদীর তীরে দাড়িয়ে হিজল গাছটা নিয়ে তার বিখ্যাত ভবিষ্যত্বাণীটা ঘােষণা করল। তারপর আর কাউকে হিজল গাছের ধারে কাছে দেখা যায় নি।
মানুষটা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে, কিছু করার উপায় নেই । তিনজন কিছুই হয়নি সেরকম একটা ভাব করে লোকাটাকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে যেতে থাকে। মানুষটা সরু চোখে তাদের দেখল, এবং হঠাৎ আগুনালিকে চিনতে পেরে কেমন যেন চমকে উঠল। তাকে কিছু একটি জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই তারা তাড়াতাড়ি হেঁটে সরে গেল। মানুষটা হেঁটে যেতে যেতে একটু পরে পরে পিছনে পিছনে ফিরে তাকাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছে না।
আগুনালি মাথা চুলকে বলল, দারোয়ানটা আমাকে চিনে ফেলেছে। ঝামেলা হয়ে গেল। রাজু চিন্তিত মুখে মাথা নাড়ল। সাগর বলল এখন বাসায় কোনো দারোয়ান নেই, গিয়ে মেয়েটার সাথে কথা বলতে চাও?
রাজু চমকে উঠে সাগরের দিকে তাকাল, তারপর বলল সাগর ঠিকই বলেছে। এই সুযোগ!
রংপুরে গুপ্তপাড়ায় যে বাড়িটায় আমরা ভাড়া থাকতাম, সেখানে আশ্রিতা হিসেবে থাকতেন বু। বকসাদা চুল। মুখের রেখায় বয়সের আঁকিবুকি। বেশির ভাগ দাতই নেই। ফোকলা দাঁতে হাসলে বুকে শিশুর মতাে লাগত।
বু দিনমান ভিক্ষা করতেন, রাতে এসে আমাদের ওই বাসাটায় থাকতেন। বাসাটায় আমরা সাত-আটজন শিশু। সবাইকে কী যে ভীষণ আদর করতেন! তখন চার আনায় হজমি মিলত। আট আনায় সন্দেশ কিংবা টুংটুং ঘণ্টা বাজিয়ে বাক্সগাড়ি ঠেলে নিয়ে চলা দোকানের আইসক্রিম। কতবার বুর কাছে আবদার করে টাকা নিয়েছি। | দশ পয়সা-পাঁচ পয়সার চল তখনাে উঠে যায়নি। ভিক্ষে হিসেবে সেসবই দিত লােকে। তখন বুঝিনি, আজ ভাবি, এক টাকার সমান ভিক্ষে পেতেই ওই বুড়াে শরীর নিয়ে কত হাঁটতে হতাে বুকে।
তবে আমরা একটু আবদার করলেই বুলুকোনাে জর্দার কৌটো থেকে বের করে দিতেন সিকি-আধুলি। কখনাে যে কিপ্টেমি করেননি, তা-ও নয়। বু লুকিয়ে লুকিয়ে টাকা জমাতেন, আমরা জানতাম।
“সমগ্র শিশু সাহিত্য” বইয়ের প্রধান সূচীপত্র:
* ভূমিকা
* আবোল তাবোল
* খাই খাই
* অতীতের ছবি
* অন্যান্য কবিতা
* হযবরল
* পাগলা দাশ
* বহুরুপী
* অন্যান্য গল্প
* নাটক
* জীবনী
* জীবজন্তু
* বিবিধ
* বাল্য রচনা ও অন্যান্য
* স্বরলিপি
* গ্রন্থপরিচয়
টিটন বলল, “বদমাইশ পাজী পিঁপড়ার বাচ্চা পিঁপড়া—” তারপর প্যান্টের ভিতরে যেখানে স্বাভাবিকভাবে কোনাে পিপড়া যাবার কথা না—সেখান থেকে একটা পিপড়া ধরে বের করে নিয়ে আসে। মুখ খিচিয়ে বলে “এই পিপড়াটার আমি বােঝাব মজা! কতাে বড় সাহস—আমাকে কামড় দেয়? এটাকে আজকে আমি জন্মের মতাে শিক্ষা দিব।” | একটা পিঁপড়াকে কেমন করে জন্মের মতাে শিক্ষা দেওয়া হয় আমি নিজেও সেটা দেখতে চাচ্ছিলাম। টিটন দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “এর ছয়টা ঠ্যাং ছিড়ে আমি আলাদা করে দিব।
তারপর দেখি সে কী করে। কেমন করে হাঁটে।”
বিষ পিঁপড়ার পা ছেড়ার চেষ্টা করা নেহায়েতই বােকামির কাজ, কারণ তখন সেটা টিটনের বুড়াে আঙুলে আবার কামড়ে ধরল । টিটন বলল, “আউ! আউ!” এবং কিছু বােঝার আগে সেই পিঁপড়া তার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে প্রথমে গাছের ডালে তারপর পাতার আড়ালে গিয়ে অন্য পিঁপড়াদের মাঝে গা ঢাকা দিয়ে ফেলল। সেটাকে আলাদা করে আর খুঁজে পাওয়ার কোনাে উপায় নেই। টিটন ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “দেখেছিস? দেখেছিস বদমাইশ পিপড়াটা কী করল?”
মাঘ মাসের শেষ, শীত বেশ আছে। দুই পাশে ঝােপে-ঝাপে ঘেরা সরু মাটির পথ বাহিয়া নিশ্চিন্দিপুরের কয়েকজন লােক সরস্বতীপূজার বৈকালে গ্রামের বাহিরের মাঠে নীলকণ্ঠ পাখি দেখিতে যাইতেছিল।
দলের একজন বলিল—ওহে হরি, ভূষণণা গােয়ালার দরুণ কলাবাগানটা তােমরা কি ফের জমা দিয়েছো নাকি? হরিহর সায়সূচক কিছু বলিতে গিয়া পিছন ফিরিয়া বলিল—ছেলেটা আবার কোথায় গেল? ও খােকা, খােকা-আ-আ-পথের বাঁকের আড়াল হইতে একটি ছয়-সাত বছরের ফুটফুটে সুন্দর, ছিপছিপে চেহারার ছেলে ছুটিয়া আসিয়া দলের নাগাল ধরিল।
গোল্ডেন বাইক নিয়ে বাইক রেসে যোগ দিতেই বিপদ শুরু হলো ডন ম্যারনের। কেউ একজন চায় না, ও রেসে টিকে থাকুক। গোয়েন্দা কিশোর-মুসা-রবিনের কাছে সাহা্য্য চাইল ডন। ওরা তদন্তে নামার সঙ্গে সঙ্গে আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠল কেসটা। চুরি হয়ে গেল গোল্ডেন বাইক। সবশেষে ডন নিজেই উধাও হলো। অপরাধীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে রকি বিচ থেকে সুদূর এমিটিভিলের পার্বত্যাঞ্চলে পাড়ি জমাল গোয়েন্দারা, ভয়ানক এক ষড়ঙন্ত্রের গন্ধ পেল, যা সাইকেল চুরির চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ। বিপদের পর বিপদ। প্রাণ বাঁচানোই দায় হয়ে পড়ল কিশোর গোয়েন্দাদের।
স্কুলের ভাঙা দেয়ালের ওপর যে তিনজনকে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে, ওদের একজনের নাম-রাকিব, দ্বিতীয়জন-শুভ্রা, তৃতীয়জন-ফাহাদ। দূর থেকে ওদের বেশ স্বাভাবিক মনে হলেও বেশ সিরিয়াস দুটো কাজ করার জন্য বসে আছে ওরা এখানে। নতুন একটি ছেলে এসেছে এই পাড়ায়, নাম জিনিয়ান। কিছুক্ষণের মধ্যে এই রাস্তা দিয়ে বাসায় যাবে সে। ওকে ধরে দু গালে দুটো রাম থাপ্পর দেওয়া হবে আগে, তারপর ন্যাড়া করে দেওয়া হবে পুরো মাথা।
কাজটা অবশ্য ওরা নিজেরা করবে না, গাব্বু করবে। গাব্বু হচ্ছে এ পাড়ার সবচেয়ে শক্তিশালী ছেলে। যদিও রাকিবদের বয়সীই ও, কিন্তু ওদের চেয়ে ও বেশ লম্বা এবং প্রচণ্ড মোটা। কেবল বুদ্ধিই যা একটু কম। রাকিবরা পড়ে ক্লাস সেভেনে, আর গাব্বু এখনো ক্লাস ফোরেই পড়ে আছে। এ পাশ থেকে দেখা যাচ্ছে না ওকে, দেয়ালের ওপারে লম্বা একটা খুব হাতে নিয়ে বসে আছে ও অদীর আগ্রহে। কারণ কাজ দুটো করে দিতে পারলে দুটো মেগা আইসক্রিম আর দুটো ম্যাংগো জ্যুস দেওয়ার চুক্তি হয়েছে রাকিবদের সঙ্গে।
জিনিয়ান একসময় সামনে এলো ওদের। গাব্বু অবাক হয়ে বলল, ‘ওকে থাপ্পর মারতে হবে, মাথা ন্যাড়া করতে হবে।’
তারপর?
জিনিয়ান প্রমাণ করে দিল- না, সাধারণ কোনো ছেলে সে নয়, সে জিনিয়াস।
দুর্জয় নাকের নিচে আঙুল নিয়ে বলল,‘তোমার চ্যালেঞ্জ আমি গ্রহণ করলাম। আজ এবং একটু পর থেকেই তোমার সব কিছু টের পেয়ে যাবে। দেখি, তোমার কীভাবে ধরতে পারো আমাদের।’ দুর্জয় একটু থেমে বলল. ‘এটা আমার চ্যালেঞ্জ। পাগল করে ফেলব আমরা তোমাদের। কাঁদতে কাঁদতে এলাকা ছেড়ে চলে যাবে তোমরা। আর ডিটেকটিভ ফাইভ করার সাধও মিটে যাবে চিরতরে’।
থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে এতক্ষণ কথা শুনছিল রাফিন, চুপচাপ। অর্চি, জুহাম, তৌশি আর সাবাবকে পাশ কাটিয়ে খুব দৃঢ় এবং ধীর পায়ে এগিয়ে এলো সে দুর্জয়ের সামনে। কয়েক সেকেন্ড ওর দিকে তাকেয়ে থেকে ঠা-া অথচ স্পষ্ট গলায় বলল, ‘তোমাদের প্রতিটি পাগলামি আমরা থামিয়ে দেব দুর্জয়’। নাকের নিচে আঙুল রাখল রাফিনও, ‘এটা চ্যালেঞ্জ নয়, মহাচ্যালেঞ্জ’!
ঝন্টু যে, একেবারে সকাল বেলা? আমাদের বাড়ির বাইরের বারান্দায় বসে মুড়ি চিবুতে চিবুতে প্রশ্ন করলাম। ঝন্টু আমার কাঁধে একটা ঝাকি দিয়ে বলল ; সকাল! এই বেলা নটার সময় তাের সকাল হল?
আমি আরও একমুঠো মুড়ি মুখে পুরে দিয়ে বললুম : আমি সে-কথা বলছি নে। বলছিলুম যে তুই তাে কোনােদিন এত সকালে বাড়ি থেকে
বেরুস না। তাের আব্বা না তােকে দশটার আগে বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করেছেন?
: আব্বা তাে নেই, অফিসের কাজে সিলেট গেছেন। নইলে কি আর এত সকালে বের হতে পারি?
পুরােনাে ঢাকার নন্দলাল দত্ত লেনের তিন বাই দুই নম্বর বাড়ির সবচেয়ে নিরীহ আর। সুন্দর ছেলে সুজনের দিন শুরু হয় গালমন্দ শুনে। পাড়ার মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ | পড়ে ঘরে ঢুকেই বড় চাচা শুরু করেন—হতভাগা এখনাে ঘুমােচ্ছে দেখ! আল্লা খােদার নাম তাে মুখে নেবে না কখনাে, গাছে পানি দেয়ার জন্যেও রােজ বলতে হবে!
এইটুকু বলার ভেতরও যদি সুজনের ঘুম না ভাঙে বড় চাচা হুঙ্কার ছাড়বেন— ‘এখনাে উঠলি না হারামজাদা!’
চোখে রাজ্যের ঘুম জড়িয়ে থাকলেও সুজনকে উঠতে হয়। কলতলায় গিয়ে কয়লার গুঁড়াে দিয়ে দাঁত মেজে মুখ ধুয়েই কোদাল আর বালতি ভরা পানি নিয়ে ছুটতে হয় বড় চাচার সবজি বাগানে।
বাড়ির পেছনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জমি, বড় চাচা সারা বছর সেখানে সবজির চাষ করেন। সারা বছর সেখানে কাজ থাকে সুজনের। সকাল বিকেল মিলিয়ে দিনে তিন। চার ঘন্টা এর পেছনে চলে যায়। পানি দেয়াই তাে একমাত্র কাজ নয়। মাটি কোপাতে
হয়, গাছের গােড়া নিড়িয়ে দিতে হয়, সার দিতে হয়, আগাছা বাছতে হয়, গাছের ফলনের সময় বীজতলা তৈরি করে নতুন চারা জন্মাতে হয়, সবজি বাগানের কাজ শেষ।
তার সামনে এক বাটি মুড়ি। বড় চায়ের কাপে এক কাপ চা। তিনি মুড়ি খাচ্ছেন এবং চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। নীতু তার সামনেই উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। দু'হাত দিয়ে মাথা তুলে রেখেছে, খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মামাকে দেখছে এবং বােঝার চেষ্টা করছে মামা সত্যি গল্প বলছেন, না মিথ্যা গল্প বলছেন। মিথ্যা গল্প হলে সে শুনবে না। নীতুর বয়স বেশি না। এবার ক্লাস থ্রিতে উঠেছে। তবে তার খুব বুদ্ধি। গল্পের সত্যি-মিথ্যা সে চট করে ধরে ফেলে। ঐ তাে সেদিন কাজের বুয়া তাকে গল্প বলেছে
পালকিখানা ঠাকুরমাদের আমলের। খুব দরাজ বহর তার, নবাবি ছাদের। ডাণ্ডা দুটো আট আট জন বেহারার কাঁধের মাপের। হাতে সােনার কাঁকন, কানে মােটা মাকড়ি, গায়ে লালরঙের হাতকাটা মেরজাই পরা বেহারার দল সূর্য-ডােবার রঙিন মেঘের মতাে সাবেক ধনদৌলতের সঙ্গে সঙ্গে গেছে মিলিয়ে। এই পালকির গায়ে ছিল রঙিন লাইনে আঁকজোক কাটা, কতক তার গেছে ক্ষয়ে; দাগ ধরেছে যেখানেসেখানে, নারকেলের ছােবড়া বেরিয়ে পড়েছে ভিতরের গদি থেকে। এ যেন একালের নাম-কাটা আসবাব, পড়ে আছে খাতাঞ্চিখানার বারান্দায় এক কোণে। আমার বয়স তখন সাত-আট বছর। এ সংসারে কোনাে দরকারি কাজে আমার হাত ছিল না; আর ঐ পুরানাে পালকিটাকেও সকল দরকারের কাজ থেকে বরখাস্ত করে দেওয়া হয়েছে। এইজন্যেই ওর উপরে আমার এতটা মনের টান ছিল। ও যেন সমুদ্রের মাঝখানে দ্বীপ, আর আমি ছুটির দিনের রবিনসন-ক্রুশাে, বন্ধ দরজার মধ্যে ঠিকানা হারিয়ে চার দিকের নজরবন্দি এড়িয়ে বসে আছি।
‘সিলেটিরা নিজেদের ভাষা নিয়ে কিছুটা সংকুচিত থাকে’ বলে আমি আবার তাদের আহত করছি না তাে! একটা গল্প বলি আমাদের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী সিলেটের সৈয়দ আব্দুল মজিদ সাহেবের গল্প। রবীন্দ্রনাথ এসেছেন সিলেটে। এ উপলক্ষে স্বাগত বক্তৃতার দায়িত্ব পড়েছে কাপ্তান মিয়ার উপর। উনি বললেন, আমার সিলেটি বাংলা দিয়ে এত বড় কবির কাজকে পীড়িত করতে চাই না। আমি ইংরেজিতেও বক্তৃতা দেব না। কারণ ইংরেজি বিদেশী ভাষা।
কিছু-কিছু ডাইনী অল্প বয়সে মরে যায়। আবার কিছু আছে সহজে মরে না। পাঁচ শ’-ছয় শ’ এমনকি হাজার বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। তখন অবশ্যি তারা খুব কষ্টে পড়ে যায়। গায়ের জোর কমে যায়, হাঁটা-চলা করতে পারে না। চোখে ছানি পড়ে, ভালাে দেখতে পায় না। মন্ত্রটন্ত্র ভুলে যেতে শুরু করে। এক মন্ত্রের জায়গায় অন্য মন্ত্র বলে। আগের শব্দ বলে পরে, পরেরটা বলে আগে। মন্ত্র কাজ করে না।
আকবর স্যার একা থাকেন, একবেলা খান। তাও হোটেলে খান। রাতে খান না। এটা জেনে একদিন সঞ্জু রাতে স্যারের খাওয়ার টেবিলে দেয়াল টপকে ভাত-তরকারি দিয়ে এল, স্যারকে না জানিয়ে। কিন্তু স্যার টের পেয়ে গেলেন, রাগলেনও ভীষণ। বলাই বাহুল্য শাস্তিটা দিলেন স্কুলে এবং হুঁশিয়ারি করে দিলেন। এ রকম করলে শাস্তি কিন্তু চলতেই থাকবে। তারপরের কাহিনী তো সবাই জানে। সঞ্জুর শাস্তি চলতেই থাকছিল। মাঝখানে ফারুক ঢুকে...
-তাহলে স্যার এখন কী হবে? সাহস করে মুহবি বলে বসে।
-নাহ্ এখন আর শাস্তি না্ সব শাস্তি বন্ধ। তা ছাড়া .. স্যার থামেন।
-তা ছাড়া?
-তা ছাড়া সঞ্জুর মা’টা এত ভালো রাঁধেন যে কী বলব? ..এই বুড়ো বয়সে ভাতের স্বাদটা মুখে লেগে থাকে রে...
ছড়ার সঙ্গে লুৎফর রহমান রিটনের নাম যতোটা চটজলদি প্রাসঙ্গিক হয়ে ধরা দেয় ততোটা সাহিত্যের অন্য মাধ্যমের সঙ্গে দেয় না। এর পেছনে নিহিত কারণ অবশ্য ছড়ার ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্যের তুঙ্গতা। কিন্তু এ-কথা ভুললেও চলবে না যে ছোটদের-বড়দের উভয়েরই জন্য সূক্ষহাস্যরমন্ডিত স্বতন্ত্র এক গদ্যেরও তিনি কারয়িতা। ছড়ার পাশাপাশি ছোটদের জন্য যে অনেক ধরনের গদ্যগ্রন্থও তিনি রচনা করেছেন সেটা কোনও অজানা খবর নয়। ছোটদের গল্পের বই নিখোঁজ সংবাদ (১৯৮৬) দিয়ে শুরু হয়েছিল যে যাত্রার তা ছোটদের উপন্যাস ঝন্টুপন্টুদের গোয়েন্দাগিরি (১৯৯২), ভূতের ডিমের ওমলেট (১৯৯৯) ও টোকাই আমিন টোকাই বেড়াল (২০০০)-এর মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। এই প্রবাহই আর একটু অগ্রসর হল বাচ্চা হাতির কান্ডকারখানা উপন্যাসের মাধ্যমে। লুৎফর রহমান রিটন সম্পন্ন একজন শিশুসাহিত্যিক বলে জানেন শিশুদের মনের দুনিয়ায় পৌঁছে যাবার রাস্তা। তাঁর যে কোনও লেখাতেই সূক্ষ্ম হাস্যরসের পাশাপাশি থাকে শিশুর উদ্ভটরসের জগৎ। সমকালীন ঘটনাবলি কিংবা ব্যক্তিকেও তিনি প্রাসঙ্গিক করে নেন বলে তাঁর কৌতুলহাস্যের মাত্রা আরও চড়ে ওঠে। শিশুদের প্রিয় অনুষঙ্গ পাখি ও প্রাণীর জগৎ। ছোটদের জন্য গদ্য রচনার সময়ে সে-কথা তাঁর মনে থাকে। ছড়াকার সত্তাও প্রায়শই উঁকিঝুঁকি মারে তাঁর গদ্যের চলতিপথে।