Categories


আশাপূর্ণা দেবী রচনাবলী-১০ম খণ্ড

কোটি কল্পকালের পৃথিবীর বুকে কোটি কোটি বছর ধরেই চলেছে এই লীলা। পাশাপাশি চলেছে অন্যায় আর তার প্রতিবাদ। আজকের মিছিলটা যে বিশেষ একটা কিছু তা বােঝা যাচ্ছে তার দৈর্ঘ্যে, শেষ হয়েও শেষ হচ্ছে না। একবার স্তিমিত হয়ে আসছে আওয়াজ, আবার পিছন থেকে আসছে নতুন আওয়াজের ঢেউ। অবশেষে, অনেকক্ষণের পর হালকা হয়ে এল দল, ফিকে হয়ে এল ধ্বনি, যারা পিছিয়ে পড়েছিল তারা ছুটে ছুটে আসছে, তাদের ফাকে ফাকে অন্য অন্য পথচারীর চেহারা দেখা যাচ্ছে।


রবীন্দ্র উপন্যাসঃ ইতিহাসের প্রেক্ষিতে

আমাদের কালের জাতীয় চিন্তকদের প্রধান সমস্যাও হয়েছে আজ তাই। বঙ্কিমের কালের উপন্যাসে শহুরে আদর্শ-সংঘাত বনাম গ্রামীণ জীবন-চিত্রণের বিরােধীদাবির মুখেই “বিষবৃক্ষ”-“কৃষ্ণকান্তের উইল” বনাম “স্বর্ণলতার প্রতিযােগিতা প্রখর হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথই তার মধ্যে সমসাময়িক জীবন-সমস্যার পুরাে চক্রবর্তটিকে একসঙ্গে প্রত্যক্ষ করলেন—মধুসূদনের দুটি লঘুনাটক জুড়ে যে পূর্ণবৃত্তের রূপরেখা প্রথম আভাসিত।রেনেসাঁস-বিচ্ছিন্ন বাঙালি জীবনকে তার পূর্ণায়ত ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে অবধারণের এই অন্তর্দৃষ্টি রবীন্দ্র-উপন্যাসেরই দান বাংলা সাহিত্যে—“করুণা”র অপরিণতির মধ্যেও তার হাতিয়ার-চিহ্নটি পরিস্ফুট।


মহেশ ও আদরিণী

এই নিষ্ঠুর অভিযােগে গফুরের যেন বারােধ হইয়া গেল। ক্ষণেক পরে ধীরে ধীরে কহিল, কাহন-খানেক খড় এবার ভাগে পেয়েছিলাম, কিন্তু গেল সনের বকেয়া বলে কর্তামশায় সব ধরে রাখলেন। কেঁদেকেটে হাতেপায়ে পড়ে বললাম, বাবুমশাই, হাকিম তুমি, তােমার রাজত্বি ছেড়ে আর পালাবাে কোথায়, আমাকে পণ-দশেক বিচুলিও না হয় দাও। চালে খড় নেই—একখানি ঘর, বাপ-বেটিতে থাকি, তাও না হয় তালপাতার গোঁজা-গাঁজা দিয়ে এ বর্ষাটা কাটিয়ে দেব, কিন্তু, না খেতে পেয়ে আমার মহেশ মরে যাবে।


সেরা সন্দেশ ১৩৬৮-১৩৮৭

শুরু হয়েছিল ১৩২০ সালে । আর শেষ ? অমান কথা ভাবাই যায় না । হারিয়ে গিয়েও যে আবার নতুন চেহারায় সামনে এসে দাড়ায়, সেই সন্দেশ আজও ছোটদের জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ । নিতান্ত একটি পত্রিকা তো নয়, আশ্চর্য রকমের সুন্দর আর সন্ত্রান্ত একটি প্রতিষ্ঠান । সেই প্রতিষ্ঠানের দরজা দু-দুবার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্ৰথমবার বন্ধ হয়েছিল সুকুমার রায়ের মৃত্যুর পর । আর দ্বিতীয়বার, ১৩৩৮ সালে । কিন্তু রবীন্দ্ৰনাথ ওই যে বলেছেন : “শেষ হয়ে হইল না। শেষ, সন্দেশ-এরও সেই একই ব্যাপার । সন্দেশ শেষ হলে তো ছোটদের তুলানন্দেরও সমাপ্তি, সন্দেশ তাই শেষ হয়নি । দ্বিতীয়বার বন্ধ হবার তিরিশ বছর বাদে সে আবার নতুন করে দেখা দিল । এবং এতই দীপ্ত সুন্দর কান্তি নিয়ে দেখা দিল যে, বিস্ময়ে আর আনন্দে ছোটদের তো বটেই, বড়দেরও যেন চোখের পলক আর পড়তে চায় না । দেখে, পড়ে একবাক্যে সবাইকে বলতে হয় যে, হ্যা, ছোটদের জন্য এমন ভাল পত্রিকা এ-দেশে আর কখনও বার হয়নি । রবীন্দ্ৰনাথ যেন অচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে আছেন এই পত্রিকার সঙ্গে । যে-বছর তিনি নোবেল পুরস্কার পান, সেই বছরেই উপেন্দ্ৰকিশোরের


আশাপূর্ণা দেবী রচনাবলী ৩য় খণ্ড

শরৎচন্দ্রের কথা মনে রেখে এবং তাঁর স্বমহিম অবস্থানকে যথাযথমর্যাদায় স্থাপন করেও বলা যায়, আশাপূর্ণা দেবী একালের কথাসাহিত্যে নারীমনস্তত্ত্বের শ্রেষ্ঠ রূপকার, নারীচরিত্রের সর্বোত্তম স্থপতি। কত বিচিত্র নারীর আসা-যাওয়ার ছবিতে উদ্ভাসিত তাঁর গল্প-উপন্যাস, কত আশ্চর্য ইচ্ছা-অনিচ্ছার দোলায়িত লীলায় রঙিন তাদের জীবনবৃত্তান্ত যে, মুগ্ধ বিস্ময়ে জানতে আগ্রহ হয়, এরা সবাই কি তার অভিজ্ঞতা-জগতের স্মারক? না কি, কিছু চরিত্র যতটা স্মৃতি দিয়ে ঘেরা, তার চেয়ে বেশি চরিত্র স্বপ্ন দিয়ে তৈরি?


আশাপূর্ণা দেবী রচনাবলী ৪র্থ খণ্ড

আশাপূর্ণা দেবীর লেখায় নেই কোন মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা অথবা ইতিহাস-ভূগােলের বিস্তীর্ণ ও ব্যাপক অভিজ্ঞতার স্বাদ। তিনি মূলত চার দেওয়ালের চিত্রকর, সংসারের চৌহদ্দির মধ্যেই তিনি চিরকাল খুঁজেছেন মানবজীবনের চিরন্তন সুখ-দুঃখের চাবি। যে-মানুষগুলােকে আমরা প্রতিনিয়ত চিনি কিন্তু জানি না, জানি কিন্তু চিনি না, অসামান্য প্রতিভার যাদুস্পর্শে তিনি দেখিয়েছেন আমাদের অভিজ্ঞতার ঘাটতি কোথায়, কী রহস্য সর্বদা লুকিয়ে থাকে জীবনের মর্মমূলে। অথচ এমনই আশ্চর্য, তিনি তথাকথিত শিক্ষার সূত্রে তাঁর লেখার উপকরণ সংগ্রহ করার সুযোেগ পাননি, বাইরের জগতে গিয়ে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের হৃদয়ে কান পাতার উপায় ছিল না তার।


আশাপূর্ণা দেবী রচনাবলী ৭ম খণ্ড

মােটামুটি এরকম একটা ভাবনা আমার মনকে আশ্রয় করে আছে এই খণ্ডে গৃহীত আশাপূর্ণার ছ’টি উপন্যাস, তন্ন তন্ন করে পাঠের কালমিতিতে। বিজয়ী বসন্ত’ উপন্যাসে একটা সম্ভাব্য বাস-দুর্ঘটনার নাটকীয় পরিস্থিতির মধ্যে অনন্যা যে সহযাত্রী গৌতমের সঙ্গে পরিচিত হন—সেটাও এক ধরনের অ্যাক্সিডেন্ট। তাতেই বুকের মধ্যে চাপ। তাতেই আত্মবিশ্লেষণ। তাতেই রাতে বেলার গান আসে তার মনে। এই নিয়ে গল্প চলতে থাকলে একটা জব্বর রােম্যান্টিক কাহিনি লেখা যেত। কিন্তু আশাপূর্ণা দেন না গল্প।


আশাপূর্ণা দেবী রচনাবলী ৫ম খণ্ড

সহানুভূতিই ছিল তার চরিত্রায়ণের মূল সুর। অপাঙক্তেয়, ব্রাত্য ও নানা কারণে সমাজে নিন্দিত মানুষেরাও আশাপূর্ণার স্নেহব্যাকুল করুণা থেকে বঞ্চিত হয়নি; যে শিল্পীজনােচিত উদারতায় তিনি অভিজাত সমাজের সর্বতােসার্থক মানুষের জীবনদর্পণ রচনা করেছেন, সেই একই কুশলী মহিমায় তিনি চিত্রিত করেছেন সমাজের নিচু তলার ব্যর্থ-বিড়ম্বিত মানুষের স্থলনবৃত্তান্ত। এই নির্মোহ কথকতাই তাঁর রচনায় এনে দেয় দার্শনিকতার সুর, নির্লিপ্তির বেদনাঘন ছায়া।


আশাপূর্ণা দেবী রচনাবলী ৯ম খণ্ড

যেহেতু আরম্ভের আরম্ভ থাকে সেই হেতু সুবর্ণলতা-র মা সত্যবতীর জোরালাে ব্যক্তিত্বের উৎসে পৌছােতে গেলে সত্যবতীর বাবা-র সংগ্রামী ব্যক্তিত্বে গিয়ে পৌছােতে, হয়। গ্রাম থেকে বিতাড়িত সত্যবতীর বাবা আবার গ্রামেই ফিরে এসে কবিরাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। মেয়েকে তিনি প্রশ্রয়ই দিয়েছিলেন, তার নিজস্ব ন্যায়-অন্যায় বােধ যাতে জেগে ওঠে। ফলে তিনি নিজেই যখন একটি মেয়েকে আসন্ন বৈধব্য থেকে বাঁচাবার জন্যে তাঁর নিজের ভাইপাে-র স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তারই সতীন করে নিয়ে এলেন তখন ভাইপাে-র সদ্য বিবাহিত প্রথম স্ত্রীর মানসিক কষ্টের কথা একবারও ভাবলেন না। আর তখনই নিজের মেয়ের কাছেই তাঁর অবিবেচনার জন্যে স্পষ্ট কথা শুনতে হয়েছিল। ভাইপাে-র বড় বৌ-এর মনে তাে সত্যিই ‘সতীন কাটার জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছিলেন বাবা!


আশাপূর্ণা দেবী রচনাবলী-২য় খণ্ড

তাই মন্দির-সংলগ্ন প্রাঙ্গণে কান্তি মুখুজ্জের অনুনয় ভারি সংকটে ফেলল হেমপ্রভাকে। তিনি ভালাে করেই জানেন তার পুত্রবধূ চিত্রলেখা এ সম্বন্ধকে গ্রাহ্যই করবে না। অথচ কান্তি মুখুজ্জে হেমপ্রভার দ্বিধার সুযােগে এ সম্মতি প্রায় জোর করে আদায় করে নিলেন, বিগ্রহকে সাক্ষী মানলেন। অন্তরাল থেকে রসিক বিধাতা যেন এইভাবে দুটি কিশাের-কিশােরীর ভাগ্য নির্ধারণ করে দিলেন। পাত্র-পাত্রীর অজ্ঞাতে বা অনবধানে তৃতীয় পক্ষ কর্তৃক দুজনের এই সম্পর্ক নির্ধারণ এবং পরবর্তী জীবনে তারই অনিবার্য টানাপােড়েনের জট তৈরি করার সূত্রটি শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলির স্মৃতি মনে আনে। প্রতিকূল ভবিষ্যতের সঙ্গে প্রচণ্ড সংগ্রামে কার জয় কার পরাজয়—সে কাহিনীর একটা নিজস্ব টেনশান আছে। শরৎচন্দ্রীয় রীতিতেই তার সন্তোষশােভন সমাধান ঘটিয়েছেন আশাপূর্ণা।


আশাপূর্ণা দেবী রচনাবলী-৬ষ্ঠ খণ্ড

বাড়ি ওঠা মানেই তাে সংসারের নিত্য ছন্দ তছনছ হয়ে গিয়ে একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা। আর ছেলেবেলার মনে তাে বিশৃঙ্খলাতেই উল্লাস। যেদিন বাড়ি বদল হবে, তার দু-চারদিন আগে থেকেই ওই ছন্দে হাত পড়ত, ভারী জিনিসগুলাে নড়িয়ে সরিয়ে একত্রে জমা করা হত, কাচের বাসনপত্র, মায় খেলনা-পুতুলের আলমারির সব জিনিস সাবধানে সন্তর্পণে আলাদা আলাদা ভাবে বেঁধে একধারে রাখা হত, দেয়ালের ছবিটবি নামিয়ে ফেলা হত, আমাদের কভাইবােনের বইখাতা শ্লেট পেন্সিল দোয়াত কলম প্রায় সবই প্যাক করে ফেলা হত। অতএব অবস্থাটা মনােরম তাতে সন্দেহ কী?


চড়াই

স্টিয়ারিঙে বসে গাড়ি চালাতে চালাতে সামনের ক্ষুদে আয়নায় ও একবার নিজেকে দেখেও নিল। সদ্য চল্লিশ পেরােনাে শরীরে একটু মেদ দু’গালে একটু মাংস ওকে আরও যুবক করে দিয়েছে। কানের দু’পাশের কঁচাপাকা চুলগুলাে দেখে নিল সমীরণ। এখানেই বয়েসটা ধরা পড়ে। নিজের মনেই একবার হাসলাে। অশােক বলেছিল, ঐ একটু একটু পাকা চুল তােমাকে বেশ একটা ব্যক্তিত্ব দিয়েছে। কথাটা শুনে ও সেদিন হেসেছিল, কিন্তু চুলের ফাঁকে ফাঁকে বয়সের এই ঈষৎ বিজ্ঞাপন ও সেজন্যেই ধরে রেখেছে কিনা কে জানে। কিংবা ও বােধহয় জানে ওর চেহারার সঙ্গে ঐ সামান্য পাকা চুলের রেখা দিব্যি মানিয়ে গেছে।


রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রাবলী

রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ থেকে সাজাদপুরে যাওয়ার সময় নিজেদের পদ্মাবােটে করে দুটি জলপথে যেতেন। এর একটি হল—শিলাইদহ থেকে পদ্মা পার হয়ে পাবনা শহরের কাছে ইছামতী নদী ধরতেন এবং ইছামতী ধরে যেতেন। ইছামতী যেখানে হুড়া সাগরে পড়েছে, সেখানে গিয়ে তিনি হুড়া সাগর ধরে বড়ল নদীতে যেতেন। কিছুটা গিয়ে বড়লের শাখা সােনাই নদী দিয়ে রাউতাড়া পর্যন্ত যেতেন। সেখান থেকে পালকিতে সাজাদপুরে কাছারির কুঠিবাড়িতে যেতেন।