উপন্যাস পড়ার সময় আমাদের ভিতর ঠিক কী হয়? আর কীভাবেই-বা উপন্যাস তার অনন্য ফল সৃষ্টি করে, যে ফল ছবি থেকে, চলচ্চিত্র থেকে বা কবিতা থেকে এত পৃথক? এই চিন্তামূলক, গভীরভাবে ব্যক্তিগত বইটিতে, ওরহান পামুক আমাদের লেখক ও পাঠকদের বিশ্বে নিয়ে যান, প্রকাশ করেন তাঁদের অন্তরঙ্গ যোগাযোগ। পামুক ‘অকপট’ কবিদের যাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে, প্রগাঢ়ভাবে, অসচেতনভাবে লিখে থাকেনও ‘ভাব প্রধান’ কবিদের : যাঁরা চিন্তাপ্রধান, আবেগাশ্রয়ী, প্রশ্নমুখর ও লেখা শব্দের কৃৎকৌশলের প্রতি জাগ্রত মধ্যে পার্থক্যের বিষয়ে বিচরণ করেন। যৌবনে পড়া প্রিয় উপন্যাসগুলির দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে, টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি, স্তাঁদাল, ফ্লবেয়ার, মান ও নাইপলের লেখা খুঁজে দেখে পামুক অকপট ও চিন্তাপ্রধানের ভিতর আন্দোলিত হতে থাকেন, অন্বেষণ করেন কাক্সিক্ষত ভারসাম্য, ঔপন্যাসিকের নির্মাণ-কৌশলের কেন্দ্রে যার অবস্থান, তিনি উপন্যাসের দৃশ্যগত ও ইন্দ্রিয়গত শক্তি নিয়ে মগ্ন থাকেন। সে শক্তির প্রাণবন্ত নিসর্গচিত্র নির্মাণের ক্ষমতা এই মুহূর্তের স্থান-কালকে প্রায় মুছে দেয়। এই অনুসন্ধানের পথে, পামুক, চরিত্র, ছক, সময় ইত্যাদির উপাদানকে বিবেচনায় আনেন, যে উপাদান গল্পবিশ্বের ‘মিষ্টি বিভ্রমকে’ রচনা করে। উপন্যাসের গভীরে নিমজ্জিত হওয়ার আনন্দের সাথে পরিচিত ব্যক্তিমাত্রেই আধুনিক উপন্যাস শিল্পের একজন অগ্রণী শিক্ষকের এই বইটি উপভোগ করবেন, শিক্ষা নেবেন গ্রন্থকারের উপলব্ধ সত্য থেকে।
তারপর তারা পাতা উল্টায়, চোখ বােলায় অন্য কোনাে খবরের শিরােনামে। কিন্তু ‘জেলার’ যে সমস্ত লােক তাদের চিনত, অনেক বছর ধরে অন্যের মুখে গল্প শুনে অথবা শুধু মুখ দেখে, তাদের কেউ এত দ্রুত পাতাটা উল্টায়নি। কেউ কেউ হয়ত অনুচ্ছেদটি কেটে পকেটে ভরেছে, রেখে দিয়েছে পুরনাে চিঠিপত্র অথবা কোনাে বইয়ের ভেতর ; সম্ভবত অশুভ কোনাে ঘটনার আলামত হিসেবে এটা তারা সংরক্ষণ করেছে। মাঝে মাঝে, হলুদ হতে থাকা কাগ দিকে তারা তাকায়, এক পলকের জন্য হলেও, গােপন এবং স আসলে খুনের ঘটনাটা তারা কখনােই আলােচনা করেনি।
মাইকেল ওণ্ডাটজের দ্য ইংলিশ পেশেন্ট দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তিলগ্নে এক ইতালিয় ভিলায় অবস্থানকারী চারটি বিনষ্ট জীবনের উপর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য আর বিক্ষিপ্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে আলোকসম্পাতকৃত বুকার প্রাইজ জয়ী উপন্যাস।হানা, নিঃশেষিত এক নার্স, অঙ্গছেদনকৃত এক তস্কর ক্যারাভ্যাজিও , সদাসতর্ক স্যাপার সৈনিক কিপ, উপরতলার রুমে বসবাসকারী নামগোত্রহীন অগ্নিদগ্ধ এক ইংরেজরোগীর আবেগ, বিশ্বাসঘাতকতা আর হারানো স্মৃতির প্রহেলিকায় তারা প্রত্যেকেই আচ্ছন্ন ।
সূচিপত্র
*দৃষ্টি ও স্পর্শ : পৃথিবী ও নভোমণ্ডল
*কি ঘটে এবং কি পর্যবেক্ষণ করা হয়
*আলোকের বেগ
*ঘড়ি আর ফুটরুল
*স্থান-কাল
*বিশিষ্ট অপেক্ষাবাদ
*স্থান-কাল অন্তর
*আইনস্টাইনের মহাকর্ষীয় বিধি
*আইনস্টাইনের মহাকর্ষীয় বিধির প্রমাণ
*ভর, ভরবেগ, শক্তি এবং ক্রিয়া
*প্রসারমান মহাবিশ্ব
*প্রচলিত রীতি এবং প্রাকৃতিক বিধি বল-এর অবলুপ্তি
*পদার্থ কি
*দার্শনিক ফলাফল
* বাট্রান্ড রাসেলের সংক্ষিপ্ত জীবনী
যুদ্ধ শেষ হওয়ার দশদিন পর আমার বােন লরা একটি সেতুর ওপর থেকে গাড়িসহ উল্টে পড়ল। সেতুটার তখন মেরামতের কাজ চলছিল: বিপদসীমা নির্দেশক চিহ্ন মাড়িয়ে সােজা সামনের দিকে এগিয়ে যায় ও, পড়ে যায় একশ' ফুট নিচে গভীর সঙ্কীর্ণ উপত্যকায়, দু'পাশের গাছ-গাছালির নতুন পাতা-গজাননা নরম ডগাগুলােকে ছিন্নভিন্ন করে নিচের দিকে যাবার সময় হঠাৎ আগুন ধরে যায় গাড়িটায়। গড়াতে গড়াতে উপত্যকার তলদেশে অগভীর ক্রিকের ভেতর গিয়ে পড়ে ওটা। সেতুর কয়েকটি ভাঙা টুকরােও হুড়মুড় করে পড়ে ওটার সঙ্গে। আগুনে পােড়া কয়েকটা কালাে টুকরাে ছাড়া আমার বােনের আর তেমন কিছু পাওয়া যায়নি।
যে সব মানুষের কথা নিয়ে আমার এই কাহিনী রচিত, তারা কিন্তু সেই ধনী প্রদেশের বাসিন্দা নয়। দুর্ভিক্ষ বিতাড়িত হয়ে দক্ষিণ দিকে হাঁটতে হাঁটতে তারা এই নানকিঙ শহরে এসে পৌঁছত। তাদের বাড়িঘরদোর সব ছিল উত্তর অঞ্চলের আনহুই প্রদেশে ... সেখানেও আমি বহুকাল বাস করেছি, তাদের মধ্যে থেকে তাদের জেনেছি চিনেছি। দুর্ভিক্ষ শেষ হয়ে গেলে, তারা আবার সেই উত্তর অঞ্চলে ফিরে যেতাে।
নিঝুম পূর্ণিমা, দূরে আকাশের গায়ে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রেখা, ফাইনম্যান এত দূরে থেকেও সাদা মানুষদের ক্যাম্পের শূকরপােড়া গন্ধ টের পায়। সে এক চিমটি মাটি তুলে তার জিভের নিচে রাখে আর মনে-মনে জপ করে। মা বসুধা আমায় তােমার কাছে রাখ, মা বসুধা আমায় তুমি আগলে রাখ। পূর্ণিমার আলােয় প্রান্তর ভেসে যাচ্ছে, আকাশে চাঁদকে মনে হচ্ছে বণিকের রূপালী আয়না, উলফ উইলাে আর সেজ ঝােপের ধূসর পাতা জ্যোৎস্নার আলােয় রূপালী দেখাচ্ছে, কেউ যেন বরফকুচি ছিটিয়ে দিয়েছে। ভরা চাঁদের আলােয় ঘােড়া চুরি করা বিপজ্জনক হােক না সে ঘােড়া মাথা মােটা সাদামানুষদের।
চার বছর আগে সে স্মৃতি হারিয়েছে। আর কয়েক মাস হলাে হারিয়েছে কথা বলার ক্ষমতা। সে সবকিছু দেখতে পায়, শুনতেও পায়। কিন্তু কোনাে জিনিসের নাম বলতে পারে না। কোনাে লােকের নামও না। অর্থাৎ সবকিছুই তার কাছে অর্থহীন। তাকে এই সাদার রাজ্যে আনা হলাে। এখানে সময়ের কোনাে অস্তিত্ব নেই। সে জানত না তার বেড কোনটি কিংবা তার বয়স কত। কিন্তু এখানে এসে সে দেখল, বেঁচে থাকতে হয় অন্যভাবে, দয়াভিক্ষা করতে হয় হেসে। একেবারে শিশুর মতাে। শিশুর মতােই সে আবেগ প্রকাশ করতে শিখল, যে আবেগগুলাে মানুষের মধ্যে শব্দহীন বয়ে যায়।
Something in her had changed, and this kept me from recognizing her at first glance. She was forty-five. Adding up her eleven births, she had spent almost ten years pregnant and at least another ten nursing her children. She had gone gray before her time, her eyes seemed larger and more startled behind her first bifocals, and she wore strict, somber mourning for the death of her mother, but she still preserved the Roman beauty of her wedding portrait, dignified now by an autumnal air. Before anything else, even before she embraced me, she said in her customary, ceremonial way:
ভিড় থেকে একটি যুবতী বেরিয়ে যাচ্ছিল তার বাড়ির দিকে—বােধ হয় দুএকটা পয়সা এনে ঐ বাজিয়েটাকে দেবার জন্যে। কিন্তু ঐ রাগী লােকটা বুঝলাে ভুল; ভাবলাে বুঝি, পয়সা দেবার ভয়ে পালাচ্ছে; তাই তাকে বিদ্রুপ করলাে। শুনে, বাজিয়েটা এবার আর চুপ করে থাকতে পারলাে না; তার আচরণের তীব্র নিন্দা করলাে। আর যায় কোথায়? একে তাে লােকটা তার কথা অবাধ্য হওয়ায় রেগে ছিল ঐ বাজিয়েটার উপর। তার মুখে নিজের কাজের সমালােচনা শুনে—আর নিজেকে সে সংযত রাখতে পারলাে না;
চিলেকোঠার ঘরটিতে জেগে শুয়ে আছি। নিচের থেকে কোনাে ঘড়িতে ছটা বাজবার আওয়াজ শুনতে পেলাম। ততক্ষণে বেশ রােদ উঠে গেছে, সিঁড়ি দিয়ে লােকজনের নামা-ওঠা শুরু হয়ে গেছে। দরজার পাশে ঘরের দেওয়ালে যেখানে ‘মর্গেনব্লাডেট' কাগজের পুরনাে সংখ্যাগুলাে সঁটা রয়েছে, সেখানে বাতিঘরের ডাইরেক্টরের একটা নােটিশ আর তার একটু বাঁ দিকে ফ্যাবিয়ান ওলসেন-এর তাজা সেঁকা পাউরুটির একটা বড়সড় বিজ্ঞাপন আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম।
চিলেকোঠার ঘরটিতে জেগে শুয়ে আছি। নিচের থেকে কোনাে ঘড়িতে ছটা বাজবার আওয়াজ শুনতে পেলাম। ততক্ষণে বেশ রােদ উঠে গেছে, সিঁড়ি দিয়ে লােকজনের নামা-ওঠা শুরু হয়ে গেছে। দরজার পাশে ঘরের দেওয়ালে যেখানে ‘মর্গেনব্লাডেট' কাগজের পুরনাে সংখ্যাগুলাে সঁটা রয়েছে, সেখানে বাতিঘরের ডাইরেক্টরের একটা নােটিশ আর তার একটু বাঁ দিকে ফ্যাবিয়ান ওলসেন-এর তাজা সেঁকা পাউরুটির একটা বড়সড় বিজ্ঞাপন আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম।
মােটা সবুজ পশমি কাপড়ে আচ্ছাদিত একটা লম্বা টেবিলের মাথায় বসে আছেন আমাদের প্রযােজক সিরহান আল-হিলালি। তার মুখমণ্ডল আর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বাজপাখির মতাে। ভাবলেশহীন চেহারা করে তিনি আল| আদির পড়া শুনেছেন, তার দু'ঠোটের মধ্যে শক্ত করে চেপে ধরে আছেন একটা দিনওয়া চুরুট, তিনি স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। আর আমরা সারসের মতাে গলা লম্বা করে আমাদের পরিচালকের পড়া | শুনছি। তার মনঃসংযােগের তীব্রতা কোনাে প্রকার বাধা দান অথবা মন্তব্যের সম্ভাবনা নাকচ করে দেয়। আমাদের সব উত্তেজনা তিনি এমন শীতলতার সাথে উপেক্ষা করেন যে, তা আমরা চেপে রাখতে বাধ্য হই।
কারাে কারাে এমনও মনে হতে পারে : জীবকালে যিনি এমন স্বল্পজ্ঞাত ও অবহেলিত ছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পরবর্তীকালে হঠাৎ-উৎসাহের অনেকটাই হয়তাে উচ্ছাস। আর এই প্রশ্ন উঠলেই তিনি আমাদের মুখােমুখি এসে দাঁড়ানআমাদেরও নয়, ইতিহাসের, যে-ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না, কিন্তু প্রাপ্য চুকিয়ে দিতে চায়। এই ধরনের পরিস্থির সামনে আমরা দেখি মােতাহের হােসেন চৌধুরীর পূর্ণ পরিচয়-পত্র এগিয়ে দিচ্ছে সমকালীন সাহিত্য-ইতিহাস।
কেউ কেউ হয়তাে এ উপন্যাসের বিস্তার ঘটিয়ে আস্ত এক গ্রন্থ কেঁদে বসতেন; কিন্তু যে কাহিনি আমি বলতে আরম্ভ করেছি, তা আমার যাপিত জীবনকে আমার সর্বশক্তি শুষে নিতে বাধ্য করেছে। আমার সকল শুদ্ধতা আমি তাতেই বিনিয়ােগ করেছি। অতএব অত্যন্ত সাদাসিধেভাবেই আমি স্মৃতির পটে যা জমেছে, সেটা বলে যাব। বর্ণনা যদি কখনাে, কোথাও টানাপােড়েনে জীর্ণ মনে হয় কারাে, তবে তাই হােক, আমি সেই হেঁড়াখোঁড়া জায়গাগুলাে জোড়াতালি দিতে যাব না। কারণ আমার মানসপটে যে ছবির ছাপ পড়েছে, তাকে পােশাক পরাবার চেষ্টা করলে, একাজে যেটুকু আনন্দ আমি পাব আশা করছি, সেটুকু কেড়ে নেয়ার শামিল হবে।